মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Thursday, December 13, 2012

বিশ্বজিত হত্যা এবং আইনের শাসন

 বিশ্বজিত হত্যা এবং আইনের শাসন 

একজন নিরীহ মানুষ, কোন দল বা রাজনীতির  সাথে যার আদৌ কোন সম্পৃক্ততা বা সম্পর্ক নেই, তাকে বলী হতে হল প্রতিহিংসার রাজনীতির। শত কাকুতি মিনতি করেও রেহাই পেলোনা হন্তারকদের হাত থেকে। তার পরিচয়, পেশা এমনকি তার হিন্দু ধর্ম পরিচয় দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি দুর্ভাগা দর্জি দোকানি যুবক বিশ্বজিৎ এর। আমার মত দল নিরপেক্ষই শুধু নয়, দল-মত নির্বিশেষে মানবতাবাদী সকল মানুষ স্তম্ভিত হয়েছেন এ ঘটনায়। শাঁখারী বাজারে নিজের দোকানে যাওয়ার জন্য যখন সে বেরিয়েছিল তখন কি কল্পনাও করতে পেরেছিল যে, তাকে এ রকম চরম অমানবিক ভাবে মৃত্যু বরণ করতে হবে?  রবিবারের ১৮ দলীয় জোটের রাজপথ অবরোধের দিন যখন এই নৃশংস ঘটনা ঘটলো তখন এই নির্দোষ মানুষটি ঐ নরপিচাশদের কাছ থেকে মানবিকতা তো পায়ইনি, আইন রক্ষাকারী বাহিনী গুলোও নুন্যতম মানবিকতা দেখায়নি, যারা ঘটনাস্থলের কাছেই উপস্থিত ছিলো। অথচ, এই দেশে গণতন্ত্র এবং আইনের শাষন সুপ্রতিষ্ঠিত বলে আমরা সরকার দলীয় নেতৃবৃন্দের মুখে বুলি আওড়াতে শুনি। এ দেশের আইন এবং আইন রক্ষাকারী বাহিনী সবই সরকারী হুকুমের তাবেদার। সুতরাং, এদের কাছ থেকে জনগণ উচ্ছাশা করে না, কিন্তু ঘটনার সময় তার প্রাণ বাচানোর যে ন্যুনতম মানবিকতা তারা দেখাতে পারত সে টুকুও তারা দেখাতে পারেনি। এটা সত্যিই দুঃখজনক।

গনমাধ্যমে প্রকাশ, অবরোধের সমর্থনে রোববার সকালে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা ঢাকার জজ কোর্টের ভেতরে মিছিল শুরু করলে জগন্নাথ কলেজ ছাত্রলীগের কর্মীরা পাল্টা মিছিল নিয়ে ওই এলাকায় চক্কর দিতে থাকে। এক পর্যায়ে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে অবরোধকারী ও বিরোধীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয় এবং কয়েকটি হাতবোমার বিস্ফারণ ঘটে। তখন ফুটপাত ধরে হাটা বিশ্বজিৎ আতংকিত হয়ে পাশের একটি মার্কেটের দোতলায় গিয়ে আশ্রয় নেন। এমতাবস্থায় ছাত্রলীগের কিছু ক্যাডার ওখানে গিয়ে লোকজনকে পেটানো শুরু করে এবং বিশ্বজিৎকে ককটেল ফোটানোর দোষ দিয়ে পেটাতে পেটাতে নিচে রাস্তায় নামিয়ে আনে এরপর ছাত্রলীগের আরেক দল কর্মী এই উন্মত্ততায় এসে যোগ দেয় এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে কোপাতে থাকে। অবশেষে অর্ধমৃত করে ফেলে রেখে যায়। ঘটনার সময় র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনী কাছেই ছিলো।

এ ধরণের ঘটনা যে বা যারাই ঘটাক, ঘটনা এড়াতে না পারার কারণে পরিশেষে এর দায় সরকারের উপরই বর্তায়। অথচ, তার উপর হামলার যে ছবি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাতে ছাত্রলীগের হামলায় বিশ্বজিৎ নিহত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠলেও এর দায় নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের আনন্দ মিছিলে হামলার পর সংঘর্ষ হয়েছে, এর দায় আওয়ামী লীগের নয়।’ সংবাদ সম্মেলনে ঐ নেতার কাছে প্রশ্ন করা হয়- ‘বিরোধী দলের অবরোধে আওয়ামী লীগের কোন কর্মসূচি না থাকলেও সহযোগী সংগঠনগুলোকে রাস্থায় দেখা গেছে। ভিক্টোরিয়া পার্কে...।’ এই পর্যায়ে প্রশ্নকর্তা সাংবাদিককে থামিয়ে দিয়ে হানিফ বলেন, ‘পুরো বিষয়টি বুঝতে হবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সিরিজ জেতায় আমরা আনন্দ মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছিলাম। অনেক জায়গায় বিরোধী দল আনন্দ মিছিলে হামলা করেছে। আনন্দ মিছিলে বোমাবাজি হয়েছে। এরপর, সংঘর্ষ হয়েছে। এর দায় আওয়ামী লীগের উপর আসতে পারে না।’

হানিফ আওয়ামী লীগের উপর এই হত্যাকান্ডের দায় নিতে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু সরকার কি এর দায় অস্বীকার করতে পারবে? র‌্যাব পুলিশ চাইলে তো এই ঘটনা এড়াতে পারত। ঘটনার আগের রাত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সিরিজ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরের দিন আনন্দ মিছিল করার জন্য আহব্বান জানান। যেখানে দেশের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজমান, উপরন্তু, পরের দিন বিরোধী জোটের পূর্ব ঘোষিত রাজপথ অবরোধের কর্মসূচি রয়েছে, সেখানে এরকম আনন্দ মিছিলের আহব্বান করা একজন রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য কতটুকু দায়িত্বশীলতা ও দুরদর্শীতার পরিচায়ক হয়েছে? নাকি অন্য কোন উদ্যেশ্যে এই আহব্বান? এরকম প্রশ্ন মোটেই অবান্তর হবে না। ছাত্রলীগ যদি আনন্দ মিছিলেই বেরিয়েছিল তাহলে তাদের হাতে লাঠিসোটা আর ধারালো অস্ত্র আসে কিভাবে? সংবাদ পত্রের ভাষ্য অনুযায়ী রাজপথ অবরোধ প্রতিরোধে পুলিশের চেয়ে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোই ছিল বেশি সক্রিয়।

বিএনপি দাবি করছে, বিশ্বজিৎ তাদের একজন কর্মী। অথচ বিশ্বজিতের পরিবার দাবি করেছে সে কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নয়। এই নির্দোষ মানুষটির আতœা হয়তো কামনা করছে একটু সহমর্মিতা একটু সুবিচার। তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জানানো উচীত একটু সমবেদনা, একটু সাহস ও আইনী সাহায্য। অথচ, এখানে শুরু হয়েছে সেই চির চেনা রাজনীতি। লাশের রাজনীতি। রাজনীতির এই পঁচা-গন্ধা অন্ধগলী থেকে আমরা কি কোনদিন বেরিয়ে আসতে পারব?

একজন বিপদগ্রস্থ মানুষ সবশেষে একটু মানবিকতা পাওয়ার আশায় বুক বাধে। আমরা সে দিকেই ফিরে যাই। পুরো জামা রক্তে রঞ্জিত মানুষটি কাকুতি মিনতি করে যে মানবতাটুকু আদায় করতে পারেনি, নিরাপত্তা বাহিনী ও যে মানবতাটুকু দেখাতে ব্যর্থ হল, অবশেষে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় রাস্থায় ফেলে যাওয়া সেই মানুষটিকে মানবতা দেখাল একজন রিকশাওয়ালা। রাস্থা থেকে তুলে মেডিকেলে নিয়ে গেল। সংবাদ মাধ্যমে আমরা জেনেছি যে, জামায়াত শিবির কর্মী সন্দেহে মেডিকেলেও ডাক্তারদের অবহেলার শিকার হয়েছে এই দুর্ভাগা মানুষটি। দীর্ঘ সময় ইমারজেন্সি রুমে বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকার পর শাঁখারীবাজার থেকে আসা ব্যবসায়ী ও স্বজনদের চেচামেচিতে তার চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু তখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। তড়িৎ ব্যবস্থা নিলে যে প্রাণটি হয়ত বাচানো যেত, সেটা আর সম্ভব হয়নি চিকিৎসকদের অবহেলায়। চিকিৎসকের কাছে আসা একজন জখমী, সে হোক একজন সস্ত্রাসী বা ক্রিমিনাল অথবা ফাসির দন্ডপ্রাপ্ত একজন পলাতক খুনি, চিকিৎসকের জন্য তার পরিচয়, সে একজন মানুষ। দল-মত বা সেন্টিমেন্টের উর্ধ্বে থেকে ডাক্তাররা এই দায়িত্বশীলতাটুকু কি দেখাতে পারতেন না? আসলে এই পুরো ঘটনায় দায়িত্বশীলগণ মানবিকতার বস্ত্রহরণ করে ছেড়েছেন।

বিশ্বজিতের পরিবার এ ঘটনায় কোন মামলা করেননি। নিহতের বড় ভাই উত্তম কুমার দাস সোমবার একটি অনলাইন নিউজকে জানিয়েছেন, ‘তারা ভয়ে মামলা করেননি।’ কিসের ভয়-তা স্পষ্ট না করে তিনি বলেছেন, ‘আপনারা তো (সাংবাদিক) সবকিছু পরিস্কার করে দিয়েছেন, কারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে।’ তিনি বিচারের ভার সরকারের উপর ছেড়ে দিয়ে বলেছেন-‘আসামীদের ধরার দায়িত্ব সরকারের। সরকার ইচ্ছা করলেই তাদের ধরতে পারে।’ এ হত্যাকান্ডে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। যদিও গনমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে হামলাকারী হিসেবে যাদের দেখা গেছে তাদের নাম মামলার আসামীর তালিকায় নেই। তারপরও আমরা সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায় থাকলাম। দেখা যাক, এ ঘটনার বিচারে কতটুকু আইনের শাষনের প্রতিফলন ঘটে। 

No comments:

Post a Comment

Pages