মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Friday, August 3, 2018

ইভটিজিং প্রতিরোধে ইসলামী অনুশাসন

লিখেছেন- সেলিম সামীর
১৩ জুন ২০১০ ইং সিলেটের ডাকে প্রকাশিত
মেয়েদেরকে উত্যক্ত্যের একটি দৃশ্য । যদিও এই আধুনিক পোষাকের দুজন মেয়ে হাসির মাধ্যেমে ব্যাপারটি ট্যাকল করেছেন।
ইভটিজিং মূলতঃ নীতিবোধ এবং মুল্যবোধ সংশ্লিষ্ট একটি ব্যাপার। আর নীতিবোধ ও মুল্যবোধ যেভাবে সুশিক্ষার সাথে অতঃপ্রোতভাবে জড়িত; তেমনিভাবে সুশিক্ষার সাথে ধর্মীয় শিক্ষা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। মুল্যবোধ বা নীতিবোধ মুলতঃ আমরা ধর্ম থেকেই শিক্ষা পাই। কারণ, মানবীয় বিবেক-বুদ্ধি যদি ঐশী জ্ঞানের বন্ধনমুক্ত হয় তাহলে তা মানবীয় প্রবৃত্তির গোলাম হয়ে পড়ে। সেখানে তখন নীতিবোধ বা মুল্যবোধের কোন শক্তিশালী ভিত থাকে না। তেমনি থাকে না নীতিবোধের নির্দিষ্ট কোন মানদণ্ড। আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মীয় জ্ঞান থেকে মুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ বিবেক বা জ্ঞানকে মানুষ বলে ‘মুক্তবুদ্ধি’। সিদ্ধান্তের ভার যখন সেই মুক্তবুদ্ধির ওপর ছেড়ে দেয়া হয়, মুলতঃ তখন মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মুক্ত তার প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা এবং স্বার্থের শিকার হয়ে পড়ে। এ কারণে কুরআনে কারীমের পরিভাষায় এমন ‘আকল’ বা জ্ঞানকে ‘হাওয়া’ বা প্রবৃত্তি বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছেঃ “সত্য যদি সে সব লোকদের প্রবৃত্তির অনুগত হয়ে যেত, তাহলে আকাশ জমিন এবং সৃষ্টিকুলের মাঝে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হত।”
-----------------------------------------------------------
ইভটিজিং আমাদের দেশে দিন দিন একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। ইভটিজিংয়ের কারণে অনেক স্কুল ছাত্রীর সুইসাইডের ঘটনাও ঘটছে। যে দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম; সে দেশে এমন নৈতিক অধঃপতন সত্যিই দুঃখজনক। এই ইভটিজিং প্রতিরোধে সরকার কিছু শাস্তিমুলক ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেকে এর জন্য সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করার প্রস্তাব করছেন। ইভটিজিং বন্ধ হোক, মেয়েরা স্বাধীনভাবে এবং নিরাপদে চলাফেরা করার মতো পরিবেশ ও সমাজ সৃষ্টি হোক, এটা সবারই কাম্য। কিন্তুু প্রশ্ন হচ্ছে, ইভটিজিং প্রতিরোধে কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে বা আইন প্রণয়ন করে তা প্রয়োগ করলেই কী ইভটিজিং বন্ধ হয়ে যাবে? এটা অতি মাত্রায় কাল্পনিক নয় কি? আইন তো দেশে অনেক আছে। চুরি, ডাকাতির বিরুদ্ধে, সন্ত্রাস-চাদাবাজের বিরুদ্ধে, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে, হাইজ্যাক, কিডন্যাপ, অস্ত্রবাজী ও বোমাবাজীর বিরুদ্ধে; কিন্তু ওসব কী বন্ধ হয়েছে? না বন্ধ করা যাচ্ছে? মোটেও বন্ধ হয়নি। তাহলে ইভটিজিং প্রতিরোধে আইন-ই কী যথেষ্ট হবে? এ বিষয়টা সরকারের একটু গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত যে, ইভটিজিং এর প্রবণতা যুব সমাজের মধ্যে আসছে কোত্থেকে, কী ভাবে তৈরী হচ্ছে এই ধরণের মন-মানষিকতা। এসবের পেছনে যে অদৃশ্য বিষয়গুলী কাজ করছে সেগুলোর ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলেই ইভটিজিং বন্ধ হতে পারে।

আইন দর্শন হচ্ছে মানবীয় বিবেক-বুদ্ধি প্রসূত একটি বিষয়। যখন আইন সংশ্লিষ্ট নতুন কোন বিষয় বা সমস্যা মানুষের সামনে আসে, নতুন কোন অপরাধ সংঘঠিত হয়; তখন এসবের সমাধানে বা প্রতিরোধে যে সিদ্ধান্তকে মানুষ নিজের জন্য বা সমাজের জন্য কল্যাণকর বলে মনে করে তাকেই আইন হিসেবে প্রণয়ন করে। তবে একটা বিষয় আমরা ভাল করেই জানি যে, আইনের প্রয়োগ হয় অপরাধীর উপর অপরাধ সংগঠিত হবার পর, আগে নয়। আর অপরাধ সংগঠন রোধ করতে আইন অক্ষম। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ইসলাম শুধু অপরাধের শাস্তির বিধানই দেয়নি, বরং মানুষ থেকে অপরাধ যাতে সংগঠিত না হয় সে জন্য মানুষের সার্বিক জীবনকে একটি সুশৃঙ্খল গন্ডির মধ্যে বেধে দিয়েছে। চারাগাছকে যেভাবে খুটির সাথে বেধে দেয়া হয় যাতে ঝড়ে উপড়ে না যায় এবং কোন দিকে হেলে না পড়ে; তেমনি ভাবে ইসলাম একটি মানব সন্তানকে নীতিবোধ আর মুল্যবোধের এমন এক শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলে যাতে সে কখনো জীবনের সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে না যায়, অনৈতিকতার অদৃশ্য ঝড়ে উড়ে না যায়। মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে ইসলাম দেয় প্রকৃতি এবং বাস্থবতার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ গাইডেন্স বা দিক নির্দেশনা। ইসলাম সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে বাধা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আর পাশাপাশি পূণ্যের প্রতিদানে ইহকালিন কল্যাণ ও পরকালিন পূরস্কার এবং পাপের পরিণামে ইহকালিন অকল্যাণ ও পরকালিন শাস্তির ঘোষণা দিয়েছে। ইহজীবনের সাথে পরজীবনের এই যুগসূত্রের মাধ্যমে ইসলাম জাগতিকতার সাথে আধ্যাত্বিকতার অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছে। আর এ কারণে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম অস্থায়ী জাগতিক অন্যায় আনন্দ-উপভোগকে বিসর্জন দেয়। পরকালীন স্থায়ী আনন্দ-সূখ লাভের জন্য ইহকালিন গড্ডালিকা প্রবাহ এবং পাপের কালিমা থেকে নিজেকে ম্ক্তু রাখে।

ইভটিজিং মূলতঃ নীতিবোধ এবং মুল্যবোধ সংশ্লিষ্ট একটি ব্যাপার। আর নীতিবোধ ও মুল্যবোধ যেভাবে সুশিক্ষার সাথে অতঃপ্রোতভাবে জড়িত; তেমনিভাবে সুশিক্ষার সাথে ধর্মীয় শিক্ষা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। মুল্যবোধ বা নীতিবোধ মুলতঃ আমরা ধর্ম থেকেই শিক্ষা পাই। কারণ, মানবীয় বিবেক-বুদ্ধি যদি ঐশী জ্ঞানের বন্ধনমুক্ত হয় তাহলে তা মানবীয় প্রবৃত্তির গোলাম হয়ে পড়ে। সেখানে তখন নীতিবোধ বা মুল্যবোধের কোন শক্তিশালী ভিত থাকে না। তেমনি থাকে না নীতিবোধের নির্দিষ্ট কোন মানদণ্ড। আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মীয় জ্ঞান থেকে মুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ বিবেক বা জ্ঞানকে মানুষ বলে ‘মুক্তবুদ্ধি’। সিদ্ধান্তের ভার যখন সেই মুক্তবুদ্ধির ওপর ছেড়ে দেয়া হয়, মুলতঃ তখন মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মুক্ত তার প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা এবং স্বার্থের শিকার হয়ে পড়ে। এ কারণে কুরআনে কারীমের পরিভাষায় এমন ‘আকল’ বা জ্ঞানকে ‘হাওয়া’ বা প্রবৃত্তি বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছেঃ “সত্য যদি সে সব লোকদের প্রবৃত্তির অনুগত হয়ে যেত, তাহলে আকাশ জমিন এবং সৃষ্টিকুলের মাঝে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হত।”
অন্য আয়াতে পৃথিবীর সমস্থ বিপর্যয়ের জন্য মানুষকেই দায়ী করে বলা হয়েছে-“জল ও স্থলের মধ্যে যত বিপর্যয়, তা মানুষের নিজ হাতের-ই কর্মফল।”(সূরাহ রোম-৪১)

আইন দর্শনের আলোচনায় দার্শনিকদের এক দলের কথা উল্ল্যেখ করা হয়েছে যাদের মতে চরিত্রকে বলা হয়, “Cognitvist Theory”। বিখ্যাত আইনবিদ ড. ফ্রয়েডমিন তার Legal Theory গ্রন্থে এই মূলনীতির সার সংক্ষেপ বর্ণনা করেছেন এভাবে-

“Reason is and ought only to be the slave of the passions and can never pretend to any other office than to serve and obey them.” (P.36)

অর্থ্যাৎঃ “বুুদ্ধি তো মানবীয় আবেগ ও প্রবৃত্তির গোলাম মাত্র। আর প্রবৃত্তির গোলাম হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। কেননা আবেগ ছাড়া বুদ্ধি কোন কাজই করতে পারে না। সে কেবল আবেগের অনুসরণ করে।”

এই মূলনীতির পরিণতি ফ্রয়েডমিনের ভাষায়ঃ

“Every thing else but also words like ‘good’ ‘bad’ ‘ought’ ‘worthy’ are purely emotive and there cannot be such a thing as ethical and moral science” (P.36-37)

অর্থ্যাৎঃ “প্রত্যেক বিষয় এমনকি ভাল-মন্দ, আবশ্যক-অনাবশ্যক ও উপযুক্ত-অনুপযুক্ত হওয়ার ধারণা আবেগ প্রসূত কথা এবং পৃথিবীতে নৈতিকতা বলতে কোন জিনিষের অস্তিত্ব নেই।”

এই দৃষ্টিভঙ্গি আইন দর্শনের ভিত্তি হওয়ার জন্য যতই ভুল বা মন্দ সাব্যস্থ হোক না কেন, এটি কিন্তুু এক ধর্মনিরপেক্ষ বিবেকের বস্তুুনিষ্ঠ ও বাস্থবধর্মী বিশ্লেষণ। বাস্থব সত্য হল, ধর্মনিরপেক্ষ বিবেকের আনুগত্যের অনিবার্য পরিণতি এছাড়া আর কিছুই হতে পারে না যে, নৈতিকতা বলতে কোন জিনিষের অস্তিত্ব পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকবে না এবং মানুষের কথা ও কাজের উপর তার প্রবৃত্তিজাত আবেগ ছাড়া অন্য কারো রাজত্ব চলবে না। ভাল-মন্দ নিরূপণের সমস্থ সিদ্ধান্ত যদি নিরেট ধর্মনিরপেক্ষ বিবেকের উপর ন্যস্থ করা হয়, তাহলে মানুষের কাছে এরূপ কোন মানদণ্ডই অবশিষ্ট থাকবে না, যার উপর ভিত্তি করে যে কোন নতুন প্রথাকে ঠেকানো যাবে। বরং অতি মূল্যবান চারিত্রিক শৃঙ্খলাও প্রগতিবাদের স্রোতে ভেসে যাবে।

উদাহরণতঃ বোনকে বিয়ে করা বৈধ নয়, এই বিধানটি আমরা ধর্ম থেকেই পাই। এখন যদি আমরা ধর্মকে পাশে রেখে দেই, তাহলে আমাদের স্বাধীন বিবেক এবং নীতিবোধের কাছে এর অবৈধতার পেছনে কোন যৌক্তিক কারণ খুজে পাব? এ জন্যই পশ্চিমা সমাজে আজ বোনকে বিয়ের বৈধতার দাবি উঠছে।

একটা বিষয় যদি আমরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব- যে শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় জ্ঞানের বন্ধন থাকে, সে শিক্ষায় শিক্ষিতদের চরিত্রে অপরাধ প্রবণতা খুবই কম। উদাহরণতঃ আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যারা গড়ে উঠে, তাদের জীবনধারার দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব যে, ইভটিজিং তো নয়ই অন্যান্য যে কোন ধরণের অপরাধ প্রবণতাও তাদের মধ্যে প্রায় নেই বললেই চলে। আমরা যে কোন পুলিশ ষ্টেশনে খোঁজ নিলে দেখতে পাব যে, মাদ্রাসা শিক্ষিত তথা ইসলামী ভাবধারায় গড়ে উঠা জনগোষ্ঠীর নামে অপরাধ সংশ্লিষ্ট মামলা হাজারে একটাও হয়তো পাওয়া যাবে না। আর এসবের মূলে রয়েছে ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাব।
ধর্মীয় মুল্যেবোধ আর নৈতিকতা শিক্ষার উপর জোর দিলে হয়ত এমন দৃশ্য দেখতে হত না।
ইসলামের পর্দা ব্যবস্থায় নারী পুরুষের জন্য এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ বিধান রাখা হয়েছে যা অতি জীবন্ত এবং বাস্থবিক। ইভটিজিং এর রিমেডি হিসেবে পর্দা ব্যবস্থা তথা চরিত্র সংশ্লিষ্ঠ ইসলামী অনুশাসন অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় নারী পুরুষের চলাফেরা, পোষাক-পরিচ্ছদ, পরস্পর মোয়ামেলাত-মোয়াশারাতে যে গাইডেন্স দেয়া হয়েছে তা অত্যন্ত সার্বজনীন, কল্যাণকর এবং প্রাকৃতিক। নারী পুরুষের মধ্যে যে পাপ কাজ সংগঠিত হয় তার মূলে রয়েছে চোঁখের দৃষ্টি। মুলতঃ চোঁখের দর্শনেই অন্তরে পাপের বাসনা জেগে উঠে। চোঁখের অসংযত দৃষ্টি-ই মানুষকে পাপের সাগরে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এ জন্যই পবিত্র কোরআনে দৃষ্টির হেফাজতের জন্য কঠোর হুশিয়ারী উচ্ছারণ করে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-“হে  নবী! মুমীন পুরুষদেরকে বলুন- তারা যেন দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাজত করে। এতে তাদের জন্য উত্তম পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। এবং ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে।”

ইমাম আবু হানিফা রঃ বলেছেনঃ নর-নারীর একে অন্যের প্রতি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ার পর পুনঃদৃষ্টি করা জায়েয নয়। রাসূলে করীম সঃ বলেছেনঃ অনিচ্ছাকৃত এক নজরের পর ইচ্ছাকৃত দ্বিতীয় নজর করো না। তোমার প্রথমটি ক্ষমার যোগ্য হতে পারে, কিন্তুু দ্বিতীয়টি ক্ষমার যোগ্য নয়।
ইসলাম নর-নারীর ড্রেসকোডের ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ বিধান দিয়েছে। নর-নারীর দেহাবরণের নির্দিষ্ট সীমারেখা পরিস্কারভাবে বর্ণনা করেছে। তেমনি ভাবে শালীন ও ভদ্র পোষাকের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে নারীদের বেলায় জাকজমকপূর্ণ, অশ্লিল এবং বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ করার মতো আবেদনময়ী পোষাক পরিধানে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মহান আল্লাহ নারী-পুরুষের দেহের আকর্ষণীয় স্থানগুলোকে পর্দা করার জন্যই পোষাকের প্রবর্তন করেছেন। কোরআনের বাণী-“হে বনী আদম!  আমি তোমাদের জন্য পোষাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি দেহাবরণ বস্ত্র। আর পরহেযগারীর পোষাকই হচ্ছে সর্বোত্তম।” (সূরাহ আরাফ, আয়াতঃ ২৬)

ইসলাম পুরুষের চেয়ে নারীর পোষাক-পরিচ্ছদ বা পর্দার ব্যাপারে বেশি কঠোরতা অবলম্বন করেছে। এটা নারীদের প্রতি কোন অবিচার বা বিদ্বেষমুলক নয় বরং তা তাদের ইজ্জত, আব্রু ও সম্ভ্রমের সুরক্ষার জন্যই। এ বিধান নারীদের স্বাধীনতাকে গন্ডিবদ্ধ করার জন্য নয়, বরং মর্যাদাহানী, শ্লীলতাহানী, লোকচক্ষুর প্রদর্শনী হওয়া এবং পণ্য হিসেবে ব্যবহার হওয়া থেকে রক্ষার জন্য। কারণ, নারীদের অসংযত পোষাক, আবেদনময়ী চলনভঙ্গি এবং অশালীন দেহ প্রদর্শনীই যুব সমাজকে অন্যায় আচরণে উস্কে দেয়।

প্রগতিবাদী, নারীবাদী বুদ্ধিজীবিরা মানতে না চাইলেও বাস্থবতা এটাই যে, জীব জগতের প্রতিটি নারী জাতিই দৈহিক গঠন শৈলির দিক থেকে আত্বরক্ষাত্বক এবং পুরুষ জাতি আক্রমনাত্বক। আধুনিক বিজ্ঞানের কথাও এটাই। বর্তমান যুগে নারীরা পুরুষের কাধে কাধ মিলিয়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে গেলেও নিজেদের মান-মর্যাদা রক্ষার বেলায় যে তারা অত্যন্ত দুর্বল তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এ জন্য কোন উদাহরণের প্রয়োজন নেই। মুলতঃ ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় পর্দার বিধান হচ্ছে নারীদের এরকম অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এবং দুর্ঘটনা থেকে রক্ষার এক অতন্দ্র প্রহরীর মতো। নারীদের পর্দা এবং তাদের চাল-চলন ও পোষাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে নীতিমালা বর্ণনা করে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
“আর মুমীন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাজত করে। তারা যেন যা এমনিতেই প্রকাশমান এমন সৌন্দর্য ছাড়া তাদের কোন রকম সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন তাদের ওড়নাকে বক্ষদেশে দিয়ে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী,পিতা, শ্বশুর, নিজ ছেলে, স্বামীর ছেলে, আপন ভাই, আপন ভ্রাতুস্পুত্র, আপন ভাগ্নে, মুসলিম মহিলা, কৃতদাস ও দাসী, কামভাবমুক্ত অশীতিপর বৃদ্ধ ও এমন নাবালক যারা এখনো নারীদের গোপনীয়তা সম্পর্কে বোঝে না- শুধু এদের ছাড়া আর কারো নিকঠ সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। (সূরাহ নূরঃ ৩১)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে-“হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মুসলিম নারীদের জানিয়ে দিন, তারা যেন তাদের শরীরের উপর চাঁদর ঢেকে দেয়, তাতে সহজেই তাদের চিনতে পারা যাবে (সম্ভ্রান্ত মহিলা বলে) এবং তাদের আর নির্যাতিতা হতে হবে না; তারা বেইজ্জতি হতে রক্ষা পাবে।” (সূরাহ আহযাব-৫৯)
উল্লেখিত আয়াতে নারী জাতির নিরাপত্তা মূলক ব্যবস্থা হিসেবেই যে আল্লাহ তায়ালা পর্দা ব্যবস্থার বিধান দিয়েছেন, তা সহজেই অনুমেয়।
রক্ষনশীল সমাজের এরকম দৃশ্যে এক তরফা ভাবে শুধু পুরুষকে কি দোষা যায়?
কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, বেপর্দা, সহশিক্ষা, উগ্র আধুনিকতা, দেহ প্রদর্শনী, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইত্যাদি পশ্চিমা সংস্কৃতিকে আমরা অগ্রগতির সোপান মনে করি আর ইসলামী বা মৌলবাদীদের (!) শিক্ষাকে মনে করি অনগ্রসরতা এবং প্রগতির পথের অন্তরায়।
আল্লামা ইকবাল কয়েকটি কথায় প্রগতিবাদের বাস্থবতাকে তুলে ধরেছেন-

নগ্ন ঊরু প্রদর্শনীর যাদুতে বাড়েনি অগ্রগতি,
দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে আসেনি উন্নতি।
ধর্মহীনতায় পায়নি তারা সাফল্য,
ইংরেজী অক্ষরেও নেই কোন যাদু মন্ত্র।
পশ্চিমা উন্নতি এসেছে কেবল তাদের জ্ঞান-বিদ্যায়,
আজ তারা মহা ধনী মোদের ছেড়ে দেয়া পেশায়।
শার্ট-প্যান্ট-টাই পরার নাম নয় প্রগতি,
দাড়ি-টুপি-পাগড়ী নয় জ্ঞান বিজ্ঞানের বিরোধী।

আমরা আজ যে পশ্চিমা প্রগতিবাদের হুবহু অনুকরণে ব্যস্থ, সেই পশ্চিমা জনগোষ্ঠি আজ ধর্মহীন প্রগতিবাদের মর্মান্তিক পরিণতিতে ধুকছে। তারা আজ প্রগতিবাদের এমন এক গ্যাড়াকলে ফেসে গেছে যে, তাদের চিন্তাবিদগণ ধর্মকেই উত্তরণের একমাত্র পথ মনে করছে।

১৯৯০ সালে লন্ডনের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত জরিপে দেখা গেছে-
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ৭৬ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী বিবাহ ব্যতীতই যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষপাতী। ৩৪ শতাংশ ছাত্রীর স্বীকারোক্তি হল, তারা ভার্সিটিতে আসার পর কুমারী থাকেনি, বর্তমানেও তাদের অন্যের সাথে অবৈধ যৌন সম্পর্ক রয়েছে। মোট মেয়ের ২৫ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রন বড়ি সেবন করে, ২১ শতাংশ অশ্লীল ও নগ্ন ছবির পত্রিকা ক্রয় করে, ৩৪ শতাংশ স্রষ্টাকে অস্বীকার করে, ৪৮ শতাংশ সমকামীতার পক্ষে, ২১ শতাংশ নেশা করে, ৫৫ শতাংশ ছাত্র মদ্যশালায় গমন করে। (ডেইলি জঙ্গ লন্ডনঃ ৫ মার্চ ১৯৯০)

বি.বি.সি বিশ হাজার নাগরিকের উপর সমীক্ষা চালিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যে, লন্ডনে শুধু এক চতুর্থাংশ পরিবার বৈধ স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতিসহ পারিবারিক জীবন যাপন করছে। অবশিষ্ট দুই তৃতীয়াংশ দাম্পত্য সম্পর্ক ছাড়াই একত্রে জীবন যাপন করছে অথবা পরীক্ষামূলক পারিবারিক জীবন কাটাচ্ছে। (জঙ্গ, ২৮ সেপ্টেঃ ১৯৯২)

পশ্চিমের বর্তমান অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। যে কারণে ধর্মের দিকে ফিরে আসার প্রবণতা পশ্চিমে বিশেষ করে আমেরিকায় খুব বেশি বেড়েছে।
অপরদিকে আমরা যদি আরব বিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র প্রত্যক্ষ করব। প্রসঙ্গ ক্রমে এখানে একজন আমেরিকান মহিলা সাংবাদিক ‘হেলেন’ এর কথা উল্ল্যেখ করা যেতে পারে। তিনি আরব দেশসমূহ ভ্রমন কালে ইসলামী সমাজে নারীর পর্দাপ্রথা ও পূতপবিত্র সামাজিক অবস্থা দেখে অত্যন্ত প্রভাবান্বিত হন। ঐ সময় যে ভাষায় তিনি তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন তা হলো-
“আরবীয় সমাজ সুষ্ঠু সমাজ। আরবের সামাজিক নীতিমালা এতই উপযোগী যে প্রতিটি তরুণীর তা গ্রহণ করা উচিত। আমেরিকা ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে তো এরকম সুশীল সামাজিক অবস্থা অনুপস্থিত। সে দেশগুলোতে নারী-পুরুষকে অবাধ মেলামেশার নিঃশর্ত অনুমতি দেয়া হয়েছে। ...চারিত্রিক গুনাবলীর কোন সুনাম নেই। সব ধরনের অশ্লীলতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্তরালে সেখানকার সমাজ উন্মাদনা ও বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ।”(আওরত, মা, বহিন, বিবি, বেটি)

নারী-পুরুষের সহশিক্ষার যে ব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু রয়েছে তার কুফল আমরা বুঝতে না পারলেও পশ্চিমারা তার ভয়াবহ পরিণতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই যে, ইভটিজিং প্রবণতার পেছনে এই সহশিক্ষা অনেকাংশেই দায়ী। আমাদের প্রগতিবাদীরা দেখলেন, পাশ্চাত্যে সহশিক্ষা প্রচলিত, তাই তারাও একে সভ্যতার সিড়ি মনে করে তার উপর আমল শুরু করে দিলেন। কিন্তুু কখনও ভেবে দেখেননি, Kinsey Report (আমেরিকার প্রসিদ্ধ যৌনশাস্ত্রবিদ প্রফেসর আল ফ্রাইড্স কিনসী দীর্ঘ পনেরো বছর গবেষণার পর যে বিশ্ব বিখ্যাত রিপোর্ট তৈরী করেছিলেন) আমেরিকার সামাজিক ভয়াবহ অধঃপতনের যে চিত্র বিশ্ববাসির সামনে তুলে ধরেছে তার উপাদান কী?  আমাদের যুব সমাজের মধ্যে যৌন উশৃঙ্খলার বিস্থার যে দিন দিন বেড়েই চলেছে তার কারণ কী এবং এর দায় কিসের উপর বর্তায় তা-ও আমাদের প্রগতিবাদীরা ভেবে দেখেননি।

আজ আমাদের অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, আইন ও সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মের গাইডেন্স নেয়া তো দূরের কথা বরং সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধর্মের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। সহশিক্ষা তো আছেই, তার সাথে এখন ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দিয়ে ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করার প্রচেষ্টা চলছে। তার সাথে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এ দেশের সংবিধানকে ধর্মনিরপেক্ষ করার প্রক্রিয়াও বাস্থবায়নাধীন। যে পশ্চিমাদের অনুকরণে আমরা এগুলোকে সময়ের দাবী ভাবছি, সেই পশ্চিমারাই আজ ধর্মনিরপেক্ষতা এবং প্রগতিবাদের ভয়াল পরিণতিতে এমন এক সামাজিক বিপর্যয়ের শিকার, যা থেকে মুক্তির জন্য ধর্মকেই মুলমন্ত্র মনে করছেন।
আইনবিদগণ আজ খুবই চিন্তিত যে, প্রগতিবাদের এই অপ্রতিরোধ্য সয়লাবের মাঝে এমন কী নীতি অবলম্বন করা যায়, যাতে কমপক্ষে কিছু উচ্ছ মানবীয় গুণাবলী সংরক্ষিত ও অপরিবর্তনীয় থাকবে। এক মার্কিন বিচারপতি কার্ডোজো লিখেছেনঃ

“আইনের জন্য আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হল, আইনের এমন এক মুলনীতি তৈরী করা যেটা হবে স্থির ও অপরিবর্তনীয় এবং বিদ্যমান পরিস্থিতির চাহিদাগুলোর মাঝে সমন্বয় বিধানকারী।” (The Growth of the Law)

এ বিষয়ে প্রখ্যাত আইন প্রণেতা জর্জ প্যাটন এর কথা সুস্পষ্টঃ-

“আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি আদর্শ সমাজে কোন্ কোন্ বিষয়গুলো সংরক্ষণ করা উচিৎ? এটি মুল্যবোধ সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আইন দর্শন এতদসংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্ব পালন করে থাকে। কিন্তুু এই ব্যাপারে আমরা দর্শনের কাছে যতই সাহায্য প্রার্থনা করি, ততই এই প্রশ্নের উত্তর মেলা কষ্টকর হয়ে পড়ে। কারণ, মূল্যবোধের এখন পর্যন্ত কোন সর্বসম্মত মাপকাঠি জানা জায়নি। বস্তুতঃ একমাত্র ধর্মই হল এমন একটি বস্তুু যাতে আমরা এঁর একটি শক্ত ভিত্তি পাই। তবে ধর্মীয় তত্বকে কেবল যৌক্তিক প্রমাণ দিয়ে বিচার করলে চলবে না বরং গভীর অনুরাগ ও বিশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহন করতে হবে।”

কোরআনে কারীম ঘোষণা করেছেঃ- যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার পক্ষ হতে আগত নিদর্শন অনুসরণ করে, সে কি তার মত, যার কাছে তার মন্দকর্ম সমূহ ভাল বলে মনে হয় এবং সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে? (সূরাহ মুহাম্মাদ-১৪)

অতএব আজ আমাদের উচিত, প্রগতিবাদের বৈধ-অবৈধের সীমা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। এবং এর পরিণতিকে যথার্থভাবে অনুধাবন করা। ইসলাম মানুষকে আধুনিকতার বিকাশের জন্য যে প্রশস্ত ক্ষেত্র দান করেছে তা গ্রহণ করা, এবং যে সব বিষয়কে অপরিবর্তনীয় বলে ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে অনধিকার চর্চা না করা। আমরা যদি ইসলামী মুল্যবোধ এবং ভাবধারার ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহন করি, নারী-পুরুষের জীবনপদ্ধতিতে ইসলাম যে সীমারেখা বেধে দিয়েছে, যে সংযত এবং পরিচ্ছন্ন বিধানাবলী নির্দিষ্ট করে দিয়েছে; সে অনুশাসন যদি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বাস্থবায়ন করতে পারি, তাহলে শুধু ইভটিজিং নয় অন্যান্য নৈতিকতা এবং চরিত্র সংশ্লিষ্ট অপরাধ প্রবণতাও ন্যুন্যতম পর্যায়ে চলে আসবে। একটি অপরাধমুক্ত সমাজ এবং কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণে ধর্মভিত্তিক শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তন ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই।

সেলিম সামীর
কলামিস্ট ও ব্লগার

No comments:

Post a Comment

Pages