মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Saturday, May 2, 2015

বেলা অবেলা


শেষ বিকেলের সূর্য্যটা খুব দ্রুত তার আলোকরশ্মিকে সংকোচিত করে দিনকে বিদায় জানাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পশ্চিম দিগন্ত লাল কমলা আর সোনালী রঙে সেজেছে অপরুপ সাজে। সোনা ধোয়া পানিতে অবগাহন করা আকাশে মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে দু চারটা করে পাখি। ডানা ঝাপটে ফিরে চলছে আপন নীড়ে। বেলকনিতে পাতা ইজি চেয়ারে আধা শোয়া তানি তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। দৃষ্টিতে গভির শূন্যতা। আকাশের রং বদলের খেলা আর দিনকে বিদায় জানানোর জন্য প্রকৃতির সকল  আয়োজন কোন কিছুই তানির দৃষ্টিতে দৃশ্যায়িত হচ্ছে না। দু গালে দেখা যাচ্ছে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দুটি ধারা। দর্শনের ক্লাশ নোট খাতাটি হাত থেকে খসে বুকের উপর পড়ে আছে। 

সামনের বাসার সানশেডে বসা কবুতরের বাক বাকুম শব্দে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠার মত নড়ে চড়ে উঠল তানি। তাকালো সেদিকে, ঠোটে ঠোট মিলাচ্ছে দুটি কবুতর। দৃশ্যটা সে আগেও বহুবার দেখেছে, কিন্তু আজকে তার শরিরটা কেমন যেন শিহরিত হয়ে উঠল। ফারহানকে ভিষনভাবে ভাবছে বলেই কি? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল। তানির চোঁখের সামনে ফোটে উঠল ফারহানের সাথে আজকের দেখা হওয়ার দৃশ্যটা। অনেকদিন পর আজ মুখোমুখি এসে পড়েছিল ফারহান। একবার তাকিয়ে তানিকে পাশ কেটে চলে যাচ্ছিল ফারহান। তানি ডাক দিল-
ফারহান ভাই! দাড়াও।
ফারহান দাড়াল। তানি দু কদম এগিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল- কেমন আছ?
ফারহান বলেছিল- ভাল আছি। স্যরি! একটু তাড়া আছে। অন্য কোন সময় কথা হবে। আসি। বলেই কোন জবাবের অপেক্ষা না করে দ্রুত চলে গিয়েছিল ফারহান। ঠায় দাড়িয়ে ফারহানের গমন পথে বিমুঢ় হয়ে তাকিয়েছিল তানি। নিজেকে চরম অপমানিত বোধ করল তানি। বাসায় ফেরার পর থেকে কোন কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না সে। বিষয়টা মন থেকে সরাতেই পারছে না। মনে নিদারুন যন্ত্রনা অনুভব করছে। একটা আত্বগ্লানি তাকে আরও বেশি কাবু করে ফেলেছে। তানি ভাবে, আজকে আমি যতটুকু অপমানিত হয়েছি,  ফারহানকে তো আমি তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি অপমান করেছি। আজকের ঘঠনা থেকে আমি যে যন্ত্রনা পাচ্ছি, সে নিশ্চয় এর চেয়ে শতগুণ বেশি যন্ত্রনা পেয়েছে। এই বোধোদয় তানিকে আত্বগ্লানীতে ফেলে দিয়েছে।
তানিশা তারান্নুম তানি দর্শনে অনার্স করছে। থার্ড ইয়ার। নাদিল ফারহানও একই বিষয়ে এ বছর মাষ্টার্স কমপ্লিট করেছে। দুজনের বাসা একই এলাকায়। রক্ষনশিল এবং ধার্মিক হওয়ায় পারিবারিকভাবেও দু ফ্যামেলির মধ্যে জানাশুনা ও যাওয়া আসা আছে। তুলনামুলকভাবে ফারহানদের পরিবার ধর্মকর্মে এগিয়ে। এলাকায় তাদের পারিবারিক সুনাম এবং ইমেজটাও আলাদা। ফারহান কলেজের পাশাপাশি যুগপৎভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা অর্জন করায় তার মাঝে জ্ঞানের অপরুপ সমন্বয় ঘটেছে। দেখতে তেমন মনে না হলেও জ্ঞানের সকল জগতেই রয়েছে তার বিচরন। ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জগতে জ্ঞানের রত্ন কুড়াতেই তার সিংহভাগ সময় ব্যায় হয়। তার মতে সব জ্ঞানই জ্ঞান। সব জ্ঞানই আল্লাহর দান। জ্ঞান যদি স্রষ্টার বিপক্ষে দাড় না করায় তবে সে জ্ঞান অর্জনে কোন বাধা নেই হোক সেটা যে কোন ধরণের জাগতিক জ্ঞান। ডিপার্টমেন্টের দেয়ালিকা, সাহিত্য সাময়িকী, বন্ধুদের মধ্যে বিভিন্ন টপিকস নিয়ে যুক্তি তর্কে সে সব সময় এগিয়েই থাকে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ফারহান সব সময় সহজ সরল জিবন যাপনেই অভ্যস্ত। কথায়ও তার কোন রাখঢাক নেই। মনের কথা অকপটে বলে ফেলে। তানির পরিবারে ফারহানের ব্যাপারে একটা আগ্রহ আছে। সেটা তানি বুঝে। পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা এবং একই ডিপার্টমেন্টে পড়ার সুবাদে দুজনে কাছাকাছি আসার এবং জানার সুযোগ হয়েছে। ব্যাক্তিগতভাবে তানিও ফারহানের প্রতি দুর্বল। তবে সেটা তার আচরনে কখনও প্রকাশ পায়নি। নিজের মধ্যেই গোপন রেখেছে। ফারহানের অবস্থান ও তার কাছে পরিস্কার নয়। তার সংযত আচরণ থেকে কখনও কোন দুর্বলতা চোঁখে পড়েনি।
একদিন দুজন কলেজের ভেতরের রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হেঠে কথা বলছিল। হঠাৎ ফারহান রাস্তার অদুরে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি একটা জায়গার দিকে ইঙ্গিত করে বলল- চলো ওদিকে যাই।
-কি ব্যাপার?
-না, তেমন কিছু না। তোমার সাথে বিশেষ একটা কথা আছে।
তানি একটু অবাক হল। চোঁখ তুলে একটু তাকাল ফারহানের দিকে। দুজনে হাঠা দিল ঐদিকে। বড়সড় একটি গাছের নীচে দুজন দাড়াল। 
-বল ফারহান ভাই কি বলবে!
ফারহান একটু গভিরভাবে তানির চোঁখের দিকে তাকাল। এমন দৃষ্টি তানির জন্য নতুন। সে কেমন জড়সড় হয়ে গেল। ফারহানের দিকে আর তাকাতে পারছেনা। চোঁখ নামিয়ে নিল তানি। তার নারী মন কিছু একটা যেন আঁচ করছে।
-আমাকে কি তোমার পছন্দ হয় তানি? সরাসরি প্রশ্ন ফারহানের।
চমকে উঠল তানি। দেহটা শিহরিত হয়ে উঠল। কম্পিত চোঁখে তাকালো সে ফারহানের দিকে। তার মন যেন এমনটাই কামনা করছিল বহু আগে থেকেই। হৃদপিন্ডটা অনেক জোরে লাফাচ্ছে। হৃদপিন্ডের ডিপ ডিপ আওয়াজ নিজের কানেই শুনতে পাচ্ছে। শরিরটাও কাপছে বুঝতে পারল।  কয়েক মুহুর্তের জন্য বিমুঢ় হয়ে গিয়েছিল তানি। তবে খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিল তানি। কন্ঠে অনেকটা কঠোরতা এবং ঝাঁঝ এনে বলল- হাউ ডেয়ার ইউ, ফারহান ভাই! তুমি আমাকে প্রপোজ করছ? কী ভেবেছ আমাকে তুমি?  আমি দুঃখিত কিন্তু আমি তোমার দুঃসাহসে সত্যিই অবাক। প্লিজ আমার সামনে থেকে সরে যাও।
তানির এমন প্রতিক্রিয়ায় ফারহান অনেকটা চমকে উঠেছিল। তানির দিকে ভালো করে থাকিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্ঠা করছিল। একটা ঢোক গিলে তারপর ছোট্র করে 'স্যরি' বলে চলে গিয়েছিল ফারহান। সেদিন দারুন আহত হয়েছিল ফারহান। তানির সম্মতি থাকলে মাস্টার্স পরীক্ষার পরেই পারিবারিকভাবে প্রস্তাব পাঠাবে এমনই ছিল তার ইচ্ছা। কিন্তু তানির রিএ্যাক্টে সে পুরোপুরি আপসেট হয়ে যায়। তানিকে একটা দাম্ভিক এবং অহংকারী মেয়ে হিসেবেই ধরে নিয়েছিল সে । সেদিনের পর থেকে ফারহান তানির সাথে আর মেশার চেষ্ঠা করেনি। সে সত্যিই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল।
তানিকে বাহ্যিকভাবে লাজুক এবং নম্র ভদ্র মনে হলেও মুলত সে একটু দুষ্টু স্বভাবের। সে ফারহানকে ক্ষ্যাপাতে চাইছিল। ছেলেরা সাধারনতঃ এসব ক্ষেত্রে যখন প্রত্যাখ্যাত হয় তখন আরও বেশি জেদি হয়ে উঠে। কাঙ্খিত মানুষকে জয় করতে মরিয়া হয়ে উঠে। তানি চেয়েছিল ফারহানও তার জন্য তেমন ক্র্যাজি হয়ে উঠুক; সে আরও জ্বলে উঠুক। কিন্তু তার সাইকোলোজিক্যাল হিসেবে ভুল ছিল। পরিস্থিতি তার হিসেবের বিপরীতেই গেছে। কিছুদিন পর যখন নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে তারপর থেকে সে ফারহানকে কাছে পাওয়ার চেষ্ঠা করেছে, কথা বলার চেষ্ঠা করেছে। কিন্তু তেমন সুযোগ হয়ে উঠেনি। কখনও ঘঠনাক্রমে দেখা মিললেও তানি কে এড়িয়ে গেছে। অনুশোচনার আগুনে অনেক জ্বলেছে সে কিন্তু ফারহানকে নিজের অবস্থান জানানোর সুযোগ করতে পারেনি। ফোনে কথা বলার জন্য নাম্বার ডায়াল করেও কল করার সাহস করতে পারেনি। ইতোমধ্যে ফারহান মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করেছে।
আজকের ঘঠনার পর বাসায় ফিরে কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না। গোসল সেরে খেতে বসে দু লোকমা খেয়েই উঠে পড়ে। বিছানায় যায়। একটু ঘুমালে হয়ত বিষয়টা মাথা থেকে দুর হবে। না, ঘুমের ছিটেফোটাও নেই চোঁখে। বিছানায় ছটফট করে অনেক্ষন। তারপর নোটখাতাটি হাতে নিয়ে ব্যালকনির ইজি চেয়ারে একটু রিলাক্স হয়ে পড়ায় মন বসানোর চেষ্ঠা করে। কিন্তু কখন যে হাত থেকে খাতাটি খসে পড়েছে ঠেরই পায়নি। চিন্তার সাগরে ঝাপ দিয়েছিল সে। অনেক কেঁদেছে সে। নিরবে। অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে ভাবেই হোক কালই ফারহানের সাথে মিট করবে। তার সব কথা সে জানাবে।
উঠে বসল তানি ইজি চেয়ার থেকে।
এতক্ষনে কবুতরগুলো তাদের খোঁপে ঢুকে গেছে। সুর্যকে একটা সোনালি থালা অথবা ডিমের কুসুমের মত মনে হচ্ছে। আকাশের বিচিত্র রং অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুধুমাত্র দিগন্তের শেষ সিমায় সোনালি রঙের মাখামাখি চলছে। এই দৃশ্যটা অপরুপ। ডিমের কুসুমটা খুব দ্রুত নীচের দিকে নামছে। মিনিট দুই তিনের মধ্যে ঘরবাড়ি এবং গাছ গাছালীর আড়াল হয়ে যাবে। তানি সে পর্যন্ত দাড়িয়ে থেকে দৃশ্যটা উপভোগ করল।
পরদিন। তানি কলেজের ভেতরে গেটের অদুরেই দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে ফারহানের। সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার পর ফোন করেছিল ফারহানকে। প্রথমে ফোন ধরেনি ফারহান। তৃতীয় কলে ফারহানের সাড়া মেলে:
-হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়াআলাইকুমুস সালাম। কাঁপা কন্ঠে জবাব দিল তানি। কেমন আছ ফারহান ভাই?
-আলহামদুলিল্লাহ! ভাল আছি। কি ব্যাপার, হঠাৎ করে এমন কল? কোন সমস্যা?
-না তেমন কোন সমস্যা নেই। একটা অনুরোধ করব।
-কী অনুরোধ? কেমন অনুরোধ??
-কিছু কথা আছে। দেখা করতে চাই এবং আজই।
-স্যরি, আমি খুবই ব্যস্ত আছি। দু চারদিন পরে সময় বের করার চেষ্ঠা করব।
-আমি দুপুর সাড়ে বারোটায় কলেজ গেটে অপেক্ষা করব। তোমার পাঁচ মিনিট সময় আমি চেয়ে নিচ্ছি। ফারহান ভাই, আমার অনুরোধটা রেখ প্লিজ! আসসালামুআলাইকুম।
ফারহানকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রেখে দিয়েছিল ফোন।
ঘড়ির কাটায় ঠিক সাড়ে বারোটা। হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে সামনে থাকাতেই দেখল ফারহান আসছে। এতক্ষন যে মনোবলটুকু সঞ্চয় করে রেখেছিল তা যেন ভেঙ্গে পড়তে চাচ্ছে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে গেছে। ফারহান দেখতে পেয়েছে তানিকে। এগিয়ে আসছে ফারহান। তানির সামনে এসে দাড়াল ফারহান।
-কি ব্যাপার বলতো? অধমকে রাজকুমারীর এমনভাবে তলবের হেতু কি?
তানি কোন কথা বলতে পারছেনা। একদম নির্বাক হয়ে গেছে। চোঁখ তুলে তাকাতে পারছেনা। আবহাওয়া তেমন গরম না হলেও ঘামছে সে। কয়েক মুহুর্ত পর কোনরকম সাহস সঞ্চয় করে কাঁপা কন্ঠে বলল 'এসো'। বলেই হাটা শুরু করল। তানি ঠিক ঐ জায়গাটার দিকেই যাচ্ছে যেখানে ফারহান তানিকে প্রপোজ করেছিল। জায়গাটা অদুরেই। তানির অবস্থা এবং রাস্তা ছেড়ে ঐদিকে হাটা দেখে ফারহান কিছুটা যেন আঁচ করতে পারছে। তাই সে আর কোন প্রশ্ন করেনি। নিরবে হাটা দিল তানির পেছন পেছন। তানি ঐ গাছটির নীচে গিয়েই ঘুরে দাড়িয়েছে। ফারহান একদম সামনেই, মুখোমুখি। তানির দৃষ্টি জমীনের দিকে। কয়েক মুহুর্ত এভাবেই কেটে গেল। তারপর যখন বুকে সাহস এনে দৃষ্টি উপরে তুলতে যাবে, নজর পড়ল ফারহানের হাতের উপর। বিয়ের কার্ড না! হ্যা, বিয়ের কার্ডই মনে হচ্ছে। চট করে তাকালো ফারহানের চোঁখের দিকে। -ওটা... কার...বিয়ের... কার্ড? কথা কন্ঠে আটকে যাচ্ছিল তানির।
অবস্থাদৃষ্টে ফারহান একটু অন্য মনস্ক হয়ে গিয়েছিল। চমকে উঠে বলল- কি বললে! ও হ্যা, আসলে আমি তিন চার দিনের মধ্যে তোমাদের বাসায়ই আসতাম। আজ যখন আসতেই হলো তাই ভাবলাম অগ্রিম তোমাকে দাওয়াতটা দিয়েই দেই। বলে হাত বাড়িয়ে কার্ডটা তানির দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল- 'আমার বিয়েতে তুমি একজন স্পেশাল গেস্ট।'
এতক্ষন তানি নিজেকে অনেক কষ্টে সংবরন করেছিল। আর পারল না। প্রলয়ংকরী আবেগোচ্ছাষের প্রবল ধাক্কায় ধৈর্য্যের বাধ চুর্ন বিচুর্ন হয়ে গেল। ভারসাম্যহীনের মত পিছু হটে গিয়ে ধাক্কা খেল গাছের সাথে। তারপর ধীরে ধীরে বসে পড়ল গাছের গোড়ায়। চোঁখ ফেঠে নেমেছে বাঁধভাঙ্গা জোয়ার। শব্দহীন বোবাকান্নায় ভেসে যাচ্ছে তানি।

No comments:

Post a Comment

Pages