মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Tuesday, October 9, 2018

বিপর্যয় মানুষের কৃতকর্মের ফল

-----------------------মোহাম্মদ আবদুল হামিদ

পাপ-পূণ্য মিলিয়েই মানুষ। জগতে মানুষ প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে, ছোট-বড়, জানা-অজানা বেহিসাব পাপ করে। কেউ পাপ করে ইচ্ছকৃতভাবে আর কেউ অনিচ্ছায়। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের গুণ হচ্ছে, যখনই তাদের দ্বারা কোন পাপকাজ হয়ে যায়, সাথে সাথে তারা পাপকাজ থেকে রুজু করে আল্লাহর কাছে তাওবা করে নেন। কিন্তু যখন মানুষ পাপকাজ করতে করতে পাপে অভ্যস্ত হয়ে যায়, পাপকাজ থেকে ফিরে আসে না, তখনই আল্লাহ তা’লা রাগান্বিত হন। তখনই মানুষের উপর নেমে আসে বিভিন্ন রকমের বালা-মুসিবত, আযাব আর গজব।

ঘুর্ণিঝড়, বন্যা, ভুমিকম্প, সুনামি, মহামারী, বজ্রপাত, নদী ভাঙ্গন আরো কতো দুর্যোগ দুনিয়ার জমিনে দেখা দেয়। এগুলোকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে অভিহিত করা হয়। একেকটা দুর্যোগ একেকটা জনপদকে বিরানভুমিতে পরিণত করে দেয়। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় ভুমিকম্প ও সুনামিতে দুই সহস্রাধিক মানুষ মৃত্যু বরণ করেছেন। অসংখ্য মানুষ খোলা আকাশের নিচে মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে দিনাতিপাত করছেন। যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইনসহ কয়েকটি দেশে ভয়াবহ টাইফুনের আঘাতে বিস্তীর্ণ জনপদে বিপর্যয় নেমে এসেছে। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ভেসে গেছে ভারতের কেরালা রাজ্য। সিরাজগঞ্জের নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে হাসপাতাল, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদরাসাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। কয়েক হাজার মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছেন। সেখানে রাজকীয় পরিবারের লোকেরাও মাথাগোজার মত একটু জায়গার সন্ধানে রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গেছে। তা-ছাড়া অতিবৃষ্টি, অকাল বন্যা, খড়া, ঝড়-তুফান এখনকার সময়ে কোন রকম প্রাকৃতিক নিয়ম-নীতি ছাড়া যখন-তখন আছড়ে পড়ে। কত স্বপ্ন ধুলিষ্যাৎ হয়ে যাচ্ছে বজ্রপাতের আঘাতে। প্রতিদিনই বজ্রপাতে মানুষ আহত-নিহত হচ্ছেন। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে অভিহিত করলেও মুলত এসব বিপর্যয় মানুষের পাপের ফলাফল। কুরআনে আল্লাহ তা’লা বলেছেন, “জলে-স্থলে যত বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, সবই মানুষের কর্মফল, তাদেরকে কোনো কোনো কর্মের শাস্তি আস্বাদন করানো হয়, যেন তারা সৎ পথে ফিরে আসে।” সুরাহ রুম: ৪১

বিজ্ঞানের মতে পরিবেশ দূষণের ফলে বিপর্যয় বেড়ে গেছে। তাও ঠিক, পরিবেশ দূষণতো মানুষই করে। মানুষের কর্মের ফলেই পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। মানুষই বন-জঙ্গল কেটে উজাড় করে, পাহাড় কেটে সমতল ভুমিতে পরিণত করে। কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য মানুষেরই তৈরী। তাই পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে জনসচেতনতা একান্তু জরুরী। সাথে সাথে পাপকর্ম থেকেও বিরত থাকা অপরিহার্য়।
মানুষের মধ্যে পূণ্যের চেয়ে পাপের মাত্রা বেড়ে গেছে। এ কারণেই দুর্যোগ-বিপর্যয়ও বাড়ছে। মানুষ যত আল্লাহর অবাধ্য হয়, বিপদ ততই ঘনিয়ে আসে। অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তা’লা বহু জাতি ও জনপদকে ধুলার সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন,  সাগরে বিলীন করে দিয়েছেন। এরকম বহু ঘটনা আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে।
হযরত নূহ (আ.) এর কওম যখন আল্লাহর অবাধ্য হয়ে পাপচারে লিপ্ত হলো, আল্লাহ তা’লা ভীষণ ক্রুব্ধ হয়ে তাদেরকে অভিশাপ দিলেন। বন্ধ করে দিলেন বৃষ্টি বর্ষণ। ফলে তাদের ফসলাদি ও প্রাণীসম্পদ কমে যেতে লাগলো। এতেও যখন তাদের বোধোদয় হলো না। তারা তাওবা করলো না। হযরত নূহ (আ.) এর কথায় কর্ণপাত করলো না। তখন তাদের উপর নেমে এলো আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন আযাব। তাদের চুলাসমুহ থেকে পানি উথলে ওঠে প্রবাহিত হতে লাগলো, আকাশ মুষলধারে অবিরাম বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলো, চারদিক থেকে অধিবাসীদের বেষ্টন করে ফেললো। নূহ (আ.) এর ছেলে কেনানসহ যারা আল্লাহর অবাধ্যতা করেছিল তাদের কেউই রক্ষা পায়নি। যখন পাপিরা সবাই পানিতে নিমজ্জিত হলো, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো- কুরআনে বর্ণিত হচ্ছে, “হে জমীন, তুমি তোমার পানি গিলে নাও, হে আসমান, তুমি বর্ষণ থেকে ক্ষান্ত হও, এক সময় পানি পশমিত হলো, আল্লাহর কাজও সম্পন্ন হলো।” সেদিন যারা হযরত নূহ (আ.) এর কথায় ঈমান এনেছিল এবং পাপকাজ থেকে ফিরে এসেছিল, শুধুমাত্র তারাই এই মহা প্লাবন থেকে রক্ষা পেয়েছিল।

অনুরূপভাবে ‘আদ’ জাতিকে আল্লাহ তা’লা অফুরন্ত নেয়ামত দান করেছিলেন। নেয়ামত পেয়ে তারা যখন আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হলো, তখন আল্লাহ তা’লা হুদ (আ.)কে তাদের কাছে নবী হিসেবে প্রেরণ করলেন। কিন্তু তারা হুদ (আ.) এর দাওয়াত অমান্য করলো। এমনকি হুদ (আ.) এর কথায় টাট্টা-বিদ্রুপ করতে লাগলো। আল্লাহ তা’লা রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দিলেন। বৃষ্টির জন্য তারা হাহাকার করতে আরম্ভ করলো। একদিন তারা আকাশে একখন্ড কালো মেঘ দেখে আনন্দে উৎসব শুরু করলো। হযরত হুদ (আ.) বললেন, এটা রহমতের মেঘ নয়, বরং তা কঠিন আযাববাহী বায়ূ। আর তা-ই হলো। প্রচন্ড ঝড় শুরু হলো। ঝড়ের আঘাতে গাছ-পালা উপড়ে ফেললো, বাড়ি-ঘর বিলীন করে দিলো এবং  পশু-পাখিকে উড়িয়ে দূরে নিয়ে গেলো। আল্লাহর গজবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো ‘আদ’ জাতি। কুরআনে বর্ণিত হচ্ছে, “ভালো করে শুনে রেখো, আদ জাতি তাদের মালিককে অস্বীকার করেছিলো; এও জেনে রেখো, ধ্বংসই ছিলো হুদের জাতি ‘আদ’ এর একমাত্র পরিণতি।” সূরা হুদ- ৬০

হযরত লূত (আ.) এর কওমের লোকেরা যখন পাপচারে লিপ্ত হলো। সমকামিতার মতো ঘৃণ্য ও জঘন্য পাপাচার যখন তাদের পেশায় পরিণত হলো। এমনকি তারা লূত (আ.) এর সাথে চরম অসভ্য আচরণ করলো। তখন তাদের উপর নেমে এলো প্রচন্ড গজব। কুরআনে বর্ণিত হচ্ছে, “অতপর যখন আমার আযাবের নির্ধারিত হুকুম এলো, তখন আমি সেই জনপদগুলোকে উল্টে দিলাম এবং তার ওপর ক্রমাগত পাকা মাটির পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করলাম।” (সূরা হুদ- ৮২) আল্লাহ তা’লা এভাবেই তাঁর অবাধ্যতাকারীদেরকে ভয়াবহ গজব দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত করে দিলেন।
‘মাদয়ান’ বাসীর কাছে প্রেরিত হলেন হযরত শুয়াইব (আ.)। তিনি তাদেরকে বলেছিলেন, হে আমার জাতি, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন মাবুদ নেই; তোমরা মাপ ও ওযনে কখনো কম করো না। কিন্তু মাদয়ানবাসী শুয়াইব (আ.) এর কথা শুনলো না, জুলুম-অত্যাচার, পাপাচারে লিপ্ত হলো। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ‘মহানাদ’ (ভয়ঙ্কর আওয়াজ) আঘাত হানলো, মুহর্তেই তারা নিজেদের ঘর সমুহে উপুড় হয়ে পড়ে রইলো। এমন অবস্থা হলো, যেন সেখানে তারা কখনো কোনো কিছু অর্জন করেনি। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “ধ্বংসই ছিলো মাদয়ানবাসীর চুড়ান্ত পরিণাম, ঠিক যেমন পরিণাম হয়েছিলো সামুদের!” সূরা হুদ- ৯৫

হযরত সালেহ (আ.) যখন তাঁর কওমকে বললেন, হে আমার জাতি, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন মাবুদ নেই, তিনি তোমাদের যমীন থেকেই পয়দা করেছেন, তাতেই তিনি তোমাদের বসবাস করিয়েছেন, অতএব তোমরা তার কাছেই গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো, এবং তাওবা করে তাঁর দিকেই ফিরে এসো। কিন্তু যখন ‘সামুদ’ জাতি হযরত সালেহ (আ.) এর কথা মানলো না, অবাধ্যতার চরম পর্যায়ে পৌঁছলো। তখন আল্লাহ তা’লা তাদেরকে ‘মহানাদ’ দিয়ে ধ্বংস করে দিলেন।

আরো কত জাতিকে আল্লাহ তা’লা এভাবে তাঁর অবাধ্যতার কারণে আযাব আর গজব দিয়ে হালাক করেছেন। আল-কুরআনে সবিস্তারে এগুলোর বিবরণ রয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরুপ আল্লাহ তা’লা কুরআনে এসব ঘটনা উল্লেখ করে মানুষকে সতর্ক করেছেন, যাতে মানুষ পাপচারে নিমজ্জিত না হয়। আল্লাহর আযাব আর গজবে ধ্বংস না হয়।

মানুষ আল্লাহর নেয়ামত ভোগ করে, অথচ তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে কুণ্ঠাবোধ করে। বিপদে পড়লে আল্লাহকে স্মরণ করে, বিপদ কেটে গেলে তাঁকে ভুলে যায়। এক আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেছেন, “তোমরা এ ব্যাপারে কি নিশ্চিত হয়ে গেছো যে, তিনি পুনরায় তোমাদেরকে সেখানে নিয়ে যাবেন না এবং তোমাদের অকৃতজ্ঞতার শাস্তিস্বরূপ তিনি অতপর প্রচন্ড ঝড় পাঠাবেন না এবং তোমাদের উত্তাল সমুদ্রে ডুবিয়ে দেবেন না! আর এমন অবস্থা দেখা দিলে তোমাদের জন্য সেদিন আমার মোকাবেলায় তোমরা কোন সাহায্যকারী পাবে না।” সুরা বনী ইসরাঈল- ৬৯

রাষ্ট্র আমাদেরকে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে এ জন্য রাষ্ট্রের আইন-কানুন মেনে চলা আমাদের জন্য অপরিহার্য। রাষ্ট্রের আইন না মানলে, রাষ্ট্র প্রধান রাগান্বিত হবেন। দুনিয়ার সাধারণ নিয়মে কেউ যদি কাউকে কিছু দেয় বা তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়, তাহলে অবশ্যই অধিনস্ত ব্যক্তিকে মনিবের আদেশ মেনে চলতে হয়। মনিবের আদেশ অমান্য করলে, মনিব রাগান্বিত হবেন। এটাই স্বাভাবিক। এই বিশ্বজগতের স্রষ্টা আমাদের প্রতিপালক মহান আল্লাহ তাঁর আপার করুণা ও মহিমায় এই বিশাল পৃথিবীকে আমাদের বসবাসের উপযোগী করে দিয়েছেন, এই মহাশূণ্য, গ্রহ-তারা, আকাশের সুবিশাল সামিয়ানা, আলো-বাতাস, আগুন-পানি-মাটি, সাগর-নদী, পশু-পাখি, অসংখ্য নেয়ামতরাজি তিনি মানুষের জীবনোপকরণ হিসেবে দান করেছেন। অন্যসব মাখলুকাতের মধ্যে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তার পরেও যদি মানুষ আল্লার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়, তাহলে তিনি কেনইবা নারাজ হবেন না? তিনি কি মানুষকে তাঁর অবাধ্যতার জন্য সৃষ্টি করেছেন? রিযিক দান করেছেন? মানুষ আল্লাহর জমিনে বিচরণ করে তাঁর সাথে কুফুরী করবে? তাঁর দেওয়া রিযিক খেয়ে তাঁর সাথে শিরক করবে? তাঁর নাফরমানি করবে? এতো মহা অন্যায়, মহা অপরাধ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আযাব আর গজবাত থেকে বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে অবশ্যই আল্লাহর একান্ত বাধ্যগত হতে হবে। তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে হবে। তাঁর বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হবে। সকল প্রকার পাপাচার থেকে বেঁচে থাকতে হবে। সর্বদা জান্নাত লাভের তীব্র আকাঙ্খা ও জাহান্নামের ভয়ঙ্কর শাস্তির ভয় অন্তরে জাগ্রত থাকতে হবে। বেশি বেশি তাওবা-ইস্তেগফার করতে হবে। আল্লাহ তা’লা আমাদেরকে তাঁর একান্ত বাধ্যগত হওয়ার এবং পাপাচার থেকে মুক্ত থাকার তাওফীক দান করুন। -আমীন।
-----------------------------------------------------------------------------------------------
মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
শিক্ষক : জামেয়া ইসলামিয়া আনওয়ারে মদিনা মাদরাসা, ইসলামপুর, সদর, সিলেট।

No comments:

Post a Comment

Pages