রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ইসলামের মুল লক্ষ্য নয়; লক্ষ্য অর্জনের পথে এটা একটি মনযিল মাত্র। আসল লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর বিধানকে কায়েম করা। সুতরাং যারাই ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারক-বাহক হবেন তাদেরকে হতে হবে একাধারে আধ্যাত্মিক ও পার্থিব যোগ্যতার অধিকারী। তাদের নিরলস সাধনা ও সংগ্রামের ফলে রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে, জীবনের প্রতিটি ধাপে সৎ কাজের প্রসার, ন্যায় ও ইনসাফ তথা সত্য সুন্দরের প্রতিষ্ঠা হবে; যাবতীয় অসৎ কাজ ও অন্যায়ের মুলোৎপাটন হবে। এ ব্যাপারে কোরআনের বাণী হচ্ছে-“(তারাই প্রকৃত মুসলমান) যদি আমি তাদেরকে পৃথিবীর বুকে ক্ষমতা প্রদান করি তাহলে তারা নামায প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত আদায় করতে সচেষ্ঠ হবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় থেকে মানুষকে বিরত রাখবে। আর সকল কাজের শেষ ফল একমাত্র আল্লাহর হাতেই।” (সূরাহ হাজ্ব-৪২)
-----------------------------------------
সেলিম সামীর
-----------------------------------------
মানুষের চিন্তা চেতনায় ইসলামের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ধারণা তৈরীতে পশ্চিমা মিডিয়ার প্রপাগান্ডা ও ইসলাম বিরোধী শক্তির বুুদ্ধিবৃত্তিক স্লো পয়জনিং এখন এমন এক পর্যায়ে এসে পৌছেছে যে, অমুসলিমরা তো বটে, মুলমানরাও ইসলামি আদর্শের ব্যাপারে ভ্রান্তির ভয়াবহ শিকার। পশ্চিমীরা এ ব্যাপারে এতটাই সফল যে, ইসলামকে ‘ইসলামফোবিয়া’ হিসেবে মানুষের মন ও মননে ঢুকিয়ে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছে। গত এক দেড় দশকে বিশেষ করে টুইন টাওয়ার ট্রাজেডি পরবর্তী সময়ে তারা ইসলাম সম্পর্কে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সচেষ্ঠ হয়েছে। এমনকি খোদ মুসলমানরাই নিজ আদর্শকে, ইসলামের রাজনৈতিক অবস্থানকে আঁড় চোখে দেখতে শুরু করেছে। যে কারনে আজ ৯০ ভাগ সংখ্যাগরিষ্ট এই মুসলিম দেশেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং ইসলামী রাজনীতি একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবিরাও আজ এই ‘ইসলামফোবিয়া’র’ ভয়ংকর শিকার। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ রাষ্ট্রনীতি এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে ইসলামকে নিষিদ্ধ করারও জোর প্রচেষ্ঠা চলছে। আসুন, আমরা অতীতে ফিরে গিয়ে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রনীতির একটি তুলনামুলক বিশ্লেষন করে নেয়া যাক।সেলিম সামীর
-----------------------------------------
অতীতের রাজা ও বাদশাহী আমলে খৃষ্টিয় সাম্রাজ্যগুলোতে শাষন ব্যবস্থা চলতো ধর্মীয় শাষনের ভিত্তিতে। আর তা ছিল মুলত: পোপতন্ত্র বা যাজকতন্ত্র। কারণ, তৎকালে পোপ বা যাজকরা যা নির্দেশ দিতেন তাই ছিলো ধর্মীয় নীতি হিসেবে শিরোধার্য। খৃষ্টিয় রাজাগণ তা-ই শাষন ব্যবস্থায় অক্ষরে অক্ষরে কার্যকর করতেন। পোপ বা যাজকদের নির্দেশের পেছনে কোন সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় নীতিমালা ছিলনা। আর থাকবেই বা কী করে যেখানে খৃষ্টধর্ম কিছু আচার-অনুষ্ঠান ছাড়া সামগ্রিক জীবন পরিচালনার ব্যাপারে নীরব। জীবনাচরণের নির্দেশনা যা-ও কিছুটা ছিলো তাদের মূল ধর্মগ্রন্থ ‘ইনযিল’ এ। তাও হারিয়ে গেছে তাদের মনগড়া সংযোজন ও বিয়োজনের মাধ্যমে। বহু সংশোধিত এবং রূপান্তরিত আজকের ‘বাইবেল’-ই সেই ‘ইনযিল’। কিন্তু আধুনিক যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব, মানুষের ক্রমবর্ধমান বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার দাবী মুকাবেলা করতে তাদের ‘ইনযিল’ ও সম্পূর্ন অসহায়। এ জন্য বিজ্ঞান খৃষ্টধর্মের সামনে এক মহা সঙ্কট হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই প্রেক্ষাপটে তাদের ধর্মীয় মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে - হয় বিজ্ঞানের বিরোধিতা নয়তো ধর্মে পরিবর্তন সাধন করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। শুরুতে রোমান ক্যাথলিক চার্চ প্রথম পন্থা অবলম্বন করে। যার কারণে গ্যালিলিও এর মত বিজ্ঞানীকেও অসংখ্য প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু গির্জা এবং পোপতন্ত্র যখন শিথিল হয়ে পড়ল, তখন ধর্মের কাট-ছাট করে নতুন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা ছাড়া আর কোন পথই থাকল না।
হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রেও ছিলো অনেকটা পোপতন্ত্রের মত অবস্থা। তবে ব্যবধানটা ছিলো হিন্দু পন্ডিত-পুরোহিতরা নরবলী, সহমরণ বা স্বামীর চিতায় আত্তাহুতির মতো অমানবিক বিষয়গুলীকে ধর্মীয় আচার বলে চালিয়ে দিলেও রাষ্ট্রের ব্যাপারে তাদের কোন নির্দেশ থাকতোনা। রাজাগণ-ই প্রয়োজনবোধে পুরোহিতদের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতেন। কিন্তু রাষ্ট্রনীতি এবং মানুষের সমাজ জীবনের চাহিদা পূরণ করতে হিন্দু ধর্মও অক্ষম। জুইস বা ইহুদী ধর্মসহ অন্যান্য সব ধর্মও শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মানব জীবনের অন্যান্য সকল দিক সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব। যার কারণে দেখা যায়, তাদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আছে; কিন্তু তার পেছনে সুস্পষ্ট কোন ধর্মীয় নীতিমালা নেই। ভারতসহ ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোতে এরকম অনেক রাজনৈতিক দল আছে।
পক্ষান্তরে, ইসলাম হচ্ছে খোদা প্রদত্ত ধর্মগুলোর মধ্যে সর্বকনিষ্ট, সর্বশেষ, সর্বাধুনিক এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন ধর্ম। এটা মানব প্রকৃতি ও মানব জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ভারসাম্যপূর্ণ জীবন বিধান। যুগের সকল চাহিদা মিটিয়ে এবং বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার দাবী পূরণ করে সকল যুগের সাথে সমতালে চলার যোগ্যতা ইসলামের আছে। ইসলাম প্রদত্ত এই জীবন বিধানকে আরবী পরিভাষায় বলা হয় ‘শরীয়াহ’ বা শরীয়ত। ইসলাম আধ্যাত্মিকতার সাথে জাগতিকতার অপরূপ সমন্বয় ঘটিয়ে ধর্মের সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছে। এখানে ‘ধর্ম’ মানে স্রেফ কিছু আচার-অনুষ্ঠানের নাম নয়; কেবলমাত্র নৈতিকতা শিক্ষার নামও নয়। এখানে যেমন আছে ব্যক্তির আত্মশুদ্ধির তরবিয়ত, জীবন পরিচালনার জন্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এবং খুটিনাটি বিষয়েও চুলচেরা নির্দেশনা; তেমনি আছে সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়-রাষ্ট্র জীবনের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা। ইসলাম প্রদত্ত এই শরীয়তে আছে ব্যবসা-বানিজ্য, অর্থনীতি-মুদ্রানীতি, লেন-দেন, পরিবার ব্যবস্থা, সমাজনীতি, দেওয়ানী-ফেীজদারী, উত্তরাধিকার আইন ইত্যাদির জন্য স্বতন্ত্র নীতিমালা।
ওহী নাযিলের ধারাবাহিকতায় কোরআনের সর্বশেষ আয়াতে আল্লাহ বলেন- “আজকের দিনে আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকেই আমি মনোনীত করে নিলাম।” (সূরাহ মায়েদাহ-৩) এই আয়াতে দ্বীন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আর এই ‘দ্বীন’ শব্দের সংজ্ঞা হাদিস বিশারদ ও তাফসির কারকরা করেছেন যে, - ‘একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতির নাম-ই হচ্ছে ‘দ্বীন’। আয়াতে ‘নিয়ামত’ শব্দ দ্বারা সত্য দ্বীন তথা স্বার্থদুষ্টতা, ত্রুটি ও কলুষতা থেকে মুক্ত এবং মানব প্রকৃতির সাথে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা বুঝানো হয়েছে। আয়াতাংশের সারমর্ম এই যে, হযরত আদম (আঃ) থেকে যে খোদায়ী নেয়ামতের অবতরণ ও প্রচলন আরম্ভ করা হয়েছিল এবং প্রত্যেক যুগ ও প্রত্যেক ভূখন্ডের অবস্থানুযায়ী এ নেয়ামত থেকে আদম সন্তানদের অংশ দেয়া হচ্ছিল নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে, আজ সেই ধর্ম ও নেয়ামতকে ষোলকলায় পূর্ণ করে শেষ নবী মোহাম্মদ (সঃ) ও তার উম্মতকে প্রদান করা হল। এর দ্বারা একথাও প্রতিয়মান হয় যে, পূর্ববর্তী ধর্মগুলো স্ব-স্ব যুগের জন্য সময়োপযোগী হলেও সর্বকালের জন্য উপযোগী ছিল না। পক্ষান্তরে ইসলামকে সর্বকালের এবং সর্বযুগের জন্য উপযোগী করে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে দেয়া হয়েছে।
মানুষ তার সামাজিক জীবনকে সুশৃঙ্খলাবদ্ধভাবে পরিচালনার জন্য যত ধরনের অথরিটি, সংস্থা বা ব্যবস্থা কায়েম করেছে তার মধ্যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা-ই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যান্য সকল সংস্থা ও অথরিটি কার্যকরী হওয়ার একমাত্র ভিত বা বুনিয়াদ। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের জীবন সুষ্টু সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়। মানুষ-ই নিজেদের সামাজিক স্বার্থে কিছু মানুষকে রাষ্ট্র ব্যবস্থার গুরু দায়িত্ব দেয় এবং নিজেরা তার আনুগত্য মেনে নেয়। এবং এই অথরিটির হাতে প্রয়োজনীয় শক্তি ও আইন প্রয়োগের ক্ষমতা অর্পণ করে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাও জনগনের স্বার্থে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা, অর্থনীতি, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদির ব্যবস্থাপনা করে। সুতরাং সমাজ জীবনের সর্ব নিম্ন পর্যায় যেমন মানুষের ব্যক্তি পর্যায় তেমনি সমাজ জীবনের সর্বোচ্ছ পর্যায় হচ্ছে ‘রাষ্ট্র’। আর ইসলামের নির্দেশনা যেহেতু ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত ব্যাপৃত, সেহেতু ইসলাম যদি রাষ্ট্র ব্যবস্থা ব্যতিরেকে শুধু ব্যক্তি পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে ইসলামের বৃহত্তর অংশই অকেজো হয়ে যেতে বাধ্য। এ জন্যই এই শরীয়ত বা জীবন ব্যবস্থার পরিপূর্ণ অনুসরণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। -“হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ কর।” (সূরাহ বাক্বারা-২০৮)
পূর্ববর্তী আসমানী ধর্মের অনুসারীদের স্বভাব ছিল, আল্লাহর বিধানগুলোর মধ্যে যেগুলো তাদের স্বার্থের অনুকূল মনে হতো, সেগুলো তারা মেনে চলত আর যে সব তাদের স্বার্থ বিরোধী হতো, সেসবকে তারা এড়িয়ে চলত। (যেমন ভাবে খৃষ্টানরা বাইবেলকে তাদের মন মতো করে সংশোধন করে নিয়েছে) তাদের এই স্বেচ্ছাচারিতা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ বলেন: “তোমরা কি (আল্লাহর) কিতাবের কিছু অংশকে মেনে চলবে আর কিছু অংশকে অস্বীকার করবে? তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করবে পার্থিব জীবনে তাদের শাস্তি- অপমান আর লাঞ্চনা ছাড়া আর কি হতে পারে? আর কিয়ামতের দিন তাদের কঠিনতম শাস্তির সম্মুখীন করা হবে।” (সূরাহ বাক্বারা-৮৫) আল্লাহর এই সুস্পষ্ট নির্দেশের পর জীবনের কোন অংশই ইসলাম বহির্ভূত মনে করার ন্যুনতম অবকাশ নেই। এ কারণেই ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সকল নবী-রাসূলগণই তাদের স্ব-স্ব যুগের সামগ্রীক শক্তিকে আল্লাহর বিধানের অধীন করার জন্যই বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। রাষ্ট্র গঠন করার মত শক্তি-ক্ষমতা যখনই তৈরী হয়েছে তখনই রাসূল (সঃ) মদীনা রাষ্ট্র গঠন করতে একটুও কালক্ষেপন করেননি।
রাষ্ট্রনীতি আল্লাহর বিধানের অনুসরনেই তৈরী হবে। এ ব্যাপারে কোরআনে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-“সাবধান! সৃষ্টি আল্লাহর, তাই বিধান দেওয়ার অধিকারও একমাত্র তার।” (সূরাহ আল-আরাফ-৫৪) “আইন ও বিধান একমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট।”(সূরাহ ইউসুফ-৪০) মানুষের সামগ্রীক জীবনে আল্লাহর বিধান সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা অতীব জরুরী। এ জন্যই আল্লাহ বলেন-“তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও যতক্ষণ না ফিতনা-ফাসাদ দুরিভূত না হয়, (ভ্রান্তী আর অন্যায়ের উপর ন্যায় ও সত্য-সুন্দরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা না পায়) আর আল্লাহর জমীনে আল্লাহর রাজত্ব কায়েম না হয়।” (সূরাহ আনফাল-৩৯) মূলতঃ পৃথিবীতে মানব প্রেরণের উদ্যেশ্যই হচ্ছে আল্লাহর জমীনে আল্লাহর বিধান কায়েমে তাহার প্রতিনিধিত্ব করা। মানব সৃষ্টির পূর্বক্ষণে আল্লাহ ফিরিশতাগণকে বলেছিলেন-“আর যখন আপনার প্রভূ ফিরিশতাগনকে বললেন, নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি প্রেরণ করব।”(সূরাহ বাক্বারা-৩০)
‘ইসলাম’ এবং ‘রাষ্ট্র’ এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, হাদীসে বলা হয়েছে,-“আল্লাহ তায়ালা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাহায্যে সেই সব জিনিস বন্ধ করে দেন যা কুরআনের সাহায্যে বন্ধ করেন না।” (-তাফসীরে ইবনে কাসির) কানযুল উম্মাল গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, “ইসলাম ও রাষ্ট্র দুই জমজ ভ্রাতা। একটি অন্যটি ব্যতিরেকে চলতে পারে না। ইসলাম একটি ভিত্তি, রাষ্ট্র ও সরকার উহার রক্ষক। ভিত্তি না থাকলে সৌধ ধ্বংস হয়ে যায় আর রক্ষক না থাকলে উহা লুন্ঠিত হয়।”
ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা এঁর জ্বলন্ত প্রমাণ দেখতে পাব। যতদিন রাষ্ট্র নায়করা নিজেদেরকে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে ভেবেছেন, সবধরণের শঠতা, কলূষতা, লোভ-লালসা, ক্ষমতার অহমিকা থেকে মুক্ত থেকে নিজের জীবনকে সম্পূর্ণ ইসলামের বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করেছেন; রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের বিধানকে প্রতিষ্ঠিত রাখার আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়ে গেছেন, ততদিন পর্যন্ত ইসলাম এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর গৌরব ছিল দুনিয়া ব্যাপি। আর যখনই তাদের পদস্খলন শুরু হয়েছে; ইসলামকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ঠেলে দুরে সরিয়ে দিয়েছেন তখন থেকেই শুরু হয়েছে তাদের মর্মান্তিক পতন। আর তাদের পতন তরান্বিত করেছে মুসলিম সালতানাত আর মুসলিম জাতিসত্বার বিপর্যয়। যেমন-খোলাফায়ে রাশেদার পরবর্তী খেলাফত ব্যবস্থা সমুহ, স্পেনের কিংবদন্তী মুসলিম শাষন, বিশ্ব কাঁপানো তুর্কি সাম্রাজ্য, ভারত বর্ষের মুসলিম সালতানাত। যে স্পেনের মুসলমানরা ছিল বিজ্ঞান আর সভ্যতার জনক, শিক্ষক; তাদের রোনাজারী আজ গুমরে মরছে আল-হামরাসহ গ্রানাডার পরিত্যক্ত প্রাসাদগুলোর কোনায় কোনায়, জাবালুত-তারীক এর (জিব্রালটার) পাদদেশে। তাদের নিদারুন পরিণতি প্রত্যক্ষ করে আজও ওয়াদিল কাবীর নদী (গোয়াদেল কুইভার) কেঁদে চলেছে অবিরাম। সভ্যতার কিংবদন্তী এক জাতির করুণ পরিণতি অবলোকন করে ‘সিরানুভিদা’ আর ‘পিরেনিজ’ পর্বতমালা আজও বোবা দৃষ্টি নিয়ে দাড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। এক সময় যে তুর্কি নৌবাহিনী দাপিয়ে বেড়িয়েছে পৃথিবীর পুরো জলভাগ; কোথায় সেই তুর্কি সাম্রাজ্যের শক্তি-মত্তা আর দাপট? মোস্তফা কামাল পাশার সেই অভিশপ্ত ধর্মনিরপেক্ষতার কুফল আজও ভোগ করতে হচ্ছে তুর্কি জনসাধারণকে। দিল্লির মুসলিম সালতানাত আর টিপু সুলতান আজ নেই, কিন্তু চরিত্রহীন মুসলিম সুলতানদের হেরেমের নর্তকীর নুপুরের সূর আর মীর জাফর মীর জুমলাদের বিশ্বাসঘাতকতা আজও চাবুকাঘাত করে চলেছে হিন্দুস্থানের মুসলমানদেরকে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ইসলামের মুল লক্ষ্য নয়; লক্ষ্য অর্জনের পথে এটা একটি মনযিল মাত্র। আসল লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর বিধানকে কায়েম করা। সুতরাং যারাই ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারক-বাহক হবেন তাদেরকে হতে হবে একাধারে আধ্যাত্মিক ও পার্থিব যোগ্যতার অধিকারী। তাদের নিরলস সাধনা ও সংগ্রামের ফলে রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে, জীবনের প্রতিটি ধাপে সৎ কাজের প্রসার, ন্যায় ও ইনসাফ তথা সত্য সুন্দরের প্রতিষ্ঠা হবে; যাবতীয় অসৎ কাজ ও অন্যায়ের মুলোৎপাটন হবে। এ ব্যাপারে কোরআনের বাণী হচ্ছে-“(তারাই প্রকৃত মুসলমান) যদি আমি তাদেরকে পৃথিবীর বুকে ক্ষমতা প্রদান করি তাহলে তারা নামায প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত আদায় করতে সচেষ্ঠ হবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় থেকে মানুষকে বিরত রাখবে। আর সকল কাজের শেষ ফল একমাত্র আল্লাহর হাতেই।” (সূরাহ হাজ্ব-৪২) সৎ কাজের আদেশ তথা সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠা আর অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখা তথা অন্যায়, অসত্য আর ভ্রান্তির কলুষতা থেকে মানব সমাজকে মুক্ত রাখাই ইসলামের প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যই মুসলিম জাতীর সৃষ্টি। ইরশাদ হচ্ছে- “তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত, মানব জাতির কল্যাণ এবং সংশোধনের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে; তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে।” ( সূরাহ আলে ইমরান-১১০) আর মুসলমানদেরকে এই কাজ চালিয়ে যেতে হবে অবিরত; শুধুমাত্র রাষ্ট্রক্ষমতা পর্যন্তই নয়। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে-“তোমরা হবে এমন একটি জাতি যে, তোমাদের একটি দল সব সময়েই বিশ্ববাসিকে কল্যাণের দিকে আহ্বান জানাবে; তাদেরকে ভালো কাজের আদেশ দিবে আর মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে।”(সূরাহ আলে ইমরান-১০৪)
এখানে একটি বিষয় লক্ষনীয় যে, উপরোক্ত দুটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আরবী ব্যাকরণের আদেশ সূচক শব্দ ‘আমর’ আর নিষেধসূচক শব্দ ‘নাহী’ ব্যবহার করেছেন। আর ক্ষমতার প্রয়োগ ছাড়া এ দুটি শব্দের কোন অর্থই হতে পারে না। কারণ, আদেশ-নিষেধ সে-ই দিতে পারে যার ক্ষমতা আছে। এ জন্যই ন্যায়ের আদেশ আর অন্যায়ের প্রতিরোধে রাষ্ট্র শক্তির প্রয়োজন অপরিহার্য।
যেহেতু ইসলাম শুধু কিছু সংখ্যক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের কর্মের নাম নয়; কিছু সংখ্যক মানুষ তার অনুসরণ করবে তাও নয়, অন্যান্য ধর্মের মত গুটিকয়েক রসম রেওয়াজের নামও নয়। ইসলাম সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রেরিত একটি পরিপূর্ণ জীবন পদ্ধতির নাম। ইসলাম চায় মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে এক স্রষ্ট্রার দাসত্বে ফিরিয়ে আনতে। মানুষকে মানুষের গড়া স্বার্থদুষ্ট আইনের গ্যাড়াকল থেকে মুক্ত করে স্রষ্টার কল্যাণময় বিধানের অধীনে এনে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে। আল্লাহ জলে ও স্থলে যে নিয়ামত মানুষের জন্য সৃষ্টি করে রেখেছেন তা সমভাবে ভোগ করার অধিকার ফিরিয়ে দিতে। আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক এবং সম্পদের সুসম বন্ঠন নিশ্চিত করতে। ইসলাম চায় মানুষের নৈতিক সংশোধন এবং আত্মশুদ্ধির পাশাপাশি জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, জীবন ও জগৎ সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি, মানব সৃষ্টি, সৃষ্ট বস্তু, সৃষ্ট জীবের সৃষ্টি রহস্য, স্রষ্টা ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক, ইহকাল ও পরকালের মধ্যেকার যুগসূত্র ইত্যাদি বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিসহ মন ও মননের আমুল পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী মানুষ গড়ে তুলতে। আর এটা তখনই সম্ভব হতে পারে, যখন সমগ্র বস্তুগত এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হবে সম্পূর্ণভাবে ইসলামের নিয়ন্ত্রনাধীন। যাবতীয় আইন-কানুন তৈরী ও প্রয়োগ করার স্বাধীন এখতিয়ার থাকবে ইসলামের।
-সেলিম সামীর
লেখক, কলামিস্ট, ব্লগার।
-সেলিম সামীর
লেখক, কলামিস্ট, ব্লগার।
No comments:
Post a Comment