ঈদুল আযহা আসে, হাজার হাজার পশুর কোরবানী হয়, শরাফতী জাহির হয়। কে কার চেয়ে বেশী সংখ্যক পশু কোরবানী করবে, কে সবার চেয়ে দামি পশু কোরবানী দিবে, কার বাড়িতে রাজার বাড়ির মত গোস্ত বিতরণ হবে, এরকম লোক দেখানো গৌরব অর্জনের প্রতিযোগিতা চলে। যার কারণে নিজেদের পশুত্বের মৃত্যু ঘটছে না, ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর যে কোরবানীর ইতিহাস তা উম্মাহর মাঝে প্রতিফলিত হচ্ছে না। পশুত্ব বিসর্জনের বদলে পশু প্রবৃত্তি, প্রাচুর্য, বিত্ত-ক্ষমতার মোহের কাছে মুসলমানদের শোচনীয় আত্মসমর্পন তাদের জন্য বেদনাদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
-------------------------------------
শাহ আহমেদ কামাল সেলিম
=====================
'কোরবানী' প্রভু প্রেমের প্রদীপ্ত শিখায় নিবেদিতপ্রাণ হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহর সময় থেকে বিধানরূপে সুচিত হয়েছে। যার নেপথ্যে দেদীপ্যমান রয়েছে ঈমানী চেতনার এক অবিস্মরনীয় আত্মত্যাগের উপাখ্যানন। হযরত ইবরাহীম (আ.) নবী জীবনে আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক কঠিন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আর সেই সকল পরীক্ষায় তিনি চুড়ান্ত সাফল্যের সহীত উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। অতঃপর তাকে মুখোমুখী হতে হয়েছিল একটি চুড়ান্ত পরীক্ষার। মহান আল্লাহ দেখতে চাইলেন আল্লহর সন্তুষ্টি অর্জনে তিনি কতটা ত্যাগী, দ্বীন কায়েমের কাজে তিনি কতটুকু অগ্রসর, জান-মালের উৎসর্গের প্রশ্নে তিনি কতটুকু নিবেদিতপ্রাণ। আল্লাহ তাকে নির্দেশ দিলেন তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানী করার জন্য। কিন্তু এ চুড়ান্ত পরীক্ষাও তিনি সাফল্যের সাথেই উত্তীর্ণ হলেন। তিনি তার প্রাণপ্রতীম পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে প্রমাণ করে দিলেন যে, হে আল্লাহ আপনার দ্বীনকে দুনিয়ার বুকে বিজয়ী করার জন্য এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য আমি আমার জান-মাল, স্ত্রী-সন্তানকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। আর এ কারণেই মহান আল্লাহর তার এ উৎসর্গকে কবুল করে নেন এবং ছুরির নিচে শায়িত ইসমাঈলের (আ.) স্থলে কোরবানী হয়ে গেল একটি জান্নাতি দুম্বা। ইবরাহীম (আ.) এর আত্মত্যাগের এ চরম পরাকাষ্টাকে কবুল করে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন ‘হে ইবরাহীম! আপনি আপনার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছেন। আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান এভাবেই দিয়ে থাকি।’
নবী ইবরাহীম (আ.) এর যুগ থেকেই মুসলমানরা এ ত্যাগ ও উৎসর্গের সাধনায় নিবেদিত। নিবেদিত পশুত্ব বিসর্জনের সাধনায়। কিন্তু তার পরও মুসলমানদের এ আত্মত্যাগ ও কোরবানীর খুলুসিয়াত এর কোথায় যেন কমতি রয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘আল্লাহর কাছে তোমাদের কোরবানীর গোশত ও রক্ত কিছুই পৌছে না। পৌছে তোমাদের অন্তরের তাক্বওয়া ও ইখলাস।’ মুসলমানদের অন্তর থেকে যেন এ তাক্বওয়া ও ইখলাস হারিয়ে গেছে, তার স্থান দখল করেছে অপসংস্কৃতির জঞ্জাল। 'কোরবানী' রুপ লাভ করেছে গৌরব অর্জন এবং শরাফতী জাহিরের উত্তম মাধ্যম হিসেবে। তাই আড়ালে দাড়িয়ে ইবলিস যেন বিদ্রুপের হাসি হাসছে। ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য এবং দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেসব জানবাজ মুজাহীদ শহীদী নাজরানাকে নিজেদের জীবনের ব্রত করে নিয়েছেন, যারা নিজেদের জান মাল, ইজ্জত-আব্রুকে দ্বীনের জন্য উৎসর্গ করে দুনিয়ার আয়েশী জীবন, বিত্ত ক্ষমতার মোহ ছিন্ন করে নিজেকে বিলীন করে দেবার জিহাদে অবতীর্ণ, মুসলিম উম্মাহের বৃহত্তর অংশ তাদের প্রতি শত্রুতায় হিংসায় ও বিদ্রুপে মত্ত। মুসলিম উম্মাহ সত্যিকারেই আজ বিভক্ত এবং দিকভ্রান্ত। যার কারণে তারা আজ অস্তিত্বের সংকটে দিশেহারা।
আজ যখন ইসমাঈলী কোরবানীর সময় এসেছে, মুসলমানদের ভাগ্যাকাশে চলছে দুর্যোগের ঘনঘটা, তাদের ভাগ্যাকাশে জমেছে দুর্যোগের কালো মেঘ। এ দুর্যোগের কারণ কি? তার শিকড় সন্ধান করার সময় হয়েছে। নবী ইবরাহীম (আ.) তার বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন প্রাণপ্রতিম পুত্র ইসমাঈলকে যতক্ষণ না আল্লাহর রাহে আক্ষরিক অর্থে কোরবানী করতে প্রবৃত্ত না হয়েছেন, ততক্ষণ কোরবানীর উদ্দীষ্ট ও নিয়তকে আল্লাহ পাক কবুল করেন নি। কিন্তু যখনই তিনি আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে তার সন্তুষ্টির জন্য তার আপন পুত্রকে কোরবানী করতে উদ্যত হলেন, তখনই আল্লাহ কোরবানী কবুল করেন। ইবরাহিম আঃ এর সেই ঈমানদীপ্ত উপাখ্যান কোরবানীর দীক্ষা ও চেতনায় মুসলিম মিল্লাতকে উদ্দীপ্ত করার কথা ছিল, কিন্তু তা হচ্ছে না। বিশ্বের মুসলমানরা প্রতি বছর অকাতরে বিপুল কোরবানী দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তার পরও বাতিলের উপর হকের চুড়ান্ত বিজয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। কোরবানীর শিক্ষা আমাদের মাঝে কোন প্রাণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করছে না। কিন্তু কেন? আমরা কি কোরবানী থেকে তার আসল শিক্ষা গ্রহণ করছি? আমরা কি কোরবানীর দীক্ষা ও চেতনায় উদ্দীপ্ত হচ্ছি? জান-মাল, সন্তান স্ত্রীকে দ্বীনের রাহে উৎসর্গ করছি বা করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি? এ বিষয়ে আমাদের ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। কোরবানীর মাধ্যমে আমরা আমাদের পিতা ইবরাহীমের সাথে আধ্যাত্বিক নাড়ীর সম্পর্ক গড়ার কথা ছিল, নিজেদের ভেতরে লালিত প্রবৃত্তির পাশবিক আচরণকে হত্যা করার কথা ছিল। কোরবানীর সময়ে আমরা ঘোষণা করি ‘ইন্না সালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহয়া ইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহী রাব্বীল আলামীন’। এই ঘোষণার মাধ্যমে একজন মুমিন যে অঙ্গীকারের কথা বলে, তা যদি তার উপলব্ধিকে জাগ্রত করত, তাহলে কোরবানী আজ পশু হত্যার নামান্তর এক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হত না।
ঈদুল আযহা আসে, হাজার হাজার পশুর কোরবানী হয়, শরাফতী জাহির হয়। কে কার চেয়ে বেশী সংখ্যক পশু কোরবানী করবে, কে সবার চেয়ে বড় পশু কোরবানী দিবে, কার বাড়িতে রাজার বাড়ির মত গোস্ত বিতরণ হবে, এরকম লোক দেখানো গৌরব অর্জনের প্রতিযোগিতা চলে। যার কারণে নিজেদের পশুত্বের মৃত্যু ঘটছে না, ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর যে কোরবানীর ইতিহাস তা উম্মাহর মাঝে প্রতিফলিত হচ্ছে না। পশুত্ব বিসর্জনের বদলে পশু প্রবৃত্তি, প্রাচুর্য, বিত্ত-ক্ষমতার মোহের কাছে মুসলমানদের শোচনীয় আত্মসমর্পন তাদের জন্য বেদনাদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তাই পবিত্র ঈদুল আযহার এ সময়ে কোরবানীকে সামনে রেখে আমাদের সকলের উচিৎ আসল কোরবানীর মানসিকতা সৃষ্টির জন্য প্রতিনিয়ত অবিরত এমন প্রয়াস প্রচেষ্টা চালানো যাতে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হয়, কাংখিত সেই সমাজ নির্মিত হয়। যে সমাজে প্রবৃত্তির পাশবিকতার উপর মনুষত্ব বিজয় লাভ করে।
------------------------------------------------------
লেখক: কলামিস্ট ও ব্লগার
No comments:
Post a Comment