হজ্ব হলো মুসলিম মিল্লাতের মহা ঐক্যের সম্মেলন। হজের সময় বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা গড়ে ওঠে। হজ্ব বিশ্ব মুসলিমের মাঝে ইসলামি চেতনা, ঐক্য ও সংহতি স্থাপন করে। ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভ হজ্ব একটি আবশ্যকীয় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ সম্পাদন করা ফরজ। এ স¤পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন- “যে সকল মুসলমানদের পথের সামর্থ আছে, তাদের ওপর আল্লাহর জন্য হজ পালন করা কর্তব্য (সূরা আলে ইমরান- ৯৭)।”
হজ্ব আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ- ইচ্ছা করা, সাক্ষাত, সফর, ভ্রমণ করা। শরিয়তের পরিভাষায় হজ বলা হয়- নির্ধারিত স্থানে (কাবা গৃহ প্রদক্ষিণ, আরাফাত ও মুজদালাফায় অবস্থান ইত্যাদি) নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ কিছু ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করা। কাবাঘরে সর্বপ্রথম হজ আদায় করেন হযরত আদম (আ.)। তারপর হযরত নূহ (আ.)সহ অন্যান্য নবী-রাসূলগণ এ দায়িত্ব পালন করেন। ইব্রাহিম (আ:) এর সময় থেকে হজ ফরয বা আবশ্যকীয় ইবাদত হিসেবে নির্ধারিত করা হয়। আল্লাহর হুকুমে হযরত ইব্রাহিম (আ:) সিরিয়া থেকে হিযরত করে কাবা শরীফের অদূরে নির্জন ভুখন্ডে আসেন। সে সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইব্রাহিম কে তিনটি নির্দেশ দেন।
১. আমার ইবাদাতে কাউকে শরীক করো না।
২. আমার গৃহকে (কাবা গৃহকে) পবিত্র রাখো।
৩. মানুষের মধ্যে ঘোষণা করে দাও যে, বায়তুল্লাহর হজ তোমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে। আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- “মানুষের মধ্যে হজের জন্য ঘোষণা প্রচার করো। তারা আসবে পায়ে হেটে এবং সর্বপ্রকার বাহনে সোওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে (সূরা হজ- ২৮)।” এ আদেশের পর হযরত ইব্রাহিম (আ:) মাকামে ইব্রাহীমে দাড়িয়ে উচ্ছ কণ্ঠে ঘোষণা করেন। কোন কোন বর্ণনায় হযরত ইব্রাহীম (আ:) আবু কোবাইস পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে অঙ্গুলি রেখে ডানে-বামে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে ঘোষণা করেছিলেন: “লোক সকল, তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর এই গৃহের হজ ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন করো”। এই বর্ণনায় আরো উল্লেখ আছে যে, হযরত ইব্রাহিম এর ঘোষণাটি স্রষ্টার পক্ষ থেকে বিশ্বের সবখানে পৌঁছে দেয়া হয়। শুধু তখনকার সময়ের জীবিত মানুষ পর্যন্ত নয়; বরং ভবিষ্যতে কেয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীতে আগমনকারী ছিল, তাদের সবার কান পর্যন্ত হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর এ ঘোষণার আওয়াজ পৌছে দেয়া হয়। যার যার ভাগ্যে আল্লাহ হজ লিখে দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই এই আওয়াজের জবাবে “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক” বলেছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন: ইব্রাহীমি আওয়াজের জওয়াবই হচ্ছে হজে ‘লাব্বাইকা’ বলার মূল ভিত্তি। (তাফসিরে মা’রিফুল কুরআন)
রাসূল (সা.)এর কাছে ৯ম হিজরীতে হজ্ব ফরজ হওয়ার আয়াত অবতীর্ণ হয়। তবে কেউ কেউ ৫ম, ৬ষ্ঠ হিজরীতে উম্মাতে মুহাম্মাদী (সা.) এর উপর হজ ফরজ হওয়ার কথা বলেছেন। জিলহজ্ব মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ হজের জন্য নির্ধরিত সময়। হজ্ব বিশ্ব মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন তথা মহা সম্মেলন। হজ্বের জন্য প্রতি বছর সারা বিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান কাবা শরীফে এসে সমবেত হন। সবার কন্ঠে একই আওয়াজ- “লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।” অর্থ- “আমি হাজির তোমার সান্নিধ্যে, হে আল্লাহ! আমি হাজির তোমার দ্বারে, আমি হাজির তোমার দরজায়, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির তোমার দরগায়। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও সব নিয়ামত তোমারই, আর তোমার রাজ্যে তোমার কোনো অংশীদার নেই।” এভাবেই আল্লাহর ঘরের মেহমানরা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে উপস্থিতির আকুতিপূর্ণ বিনীত ঘোষণা করেন।
হাজিগন মক্কা শরিফে কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা ইত্যাদি বরকতময় স্থানে অবস্থান করে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করেন। হজের পূর্বে অথবা পরে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) এর উম্মতগণ মদীনা শরীফে যান এবং রাসূলে পাক (সা.) এর রওজা মোবারক যিয়ারত, রিয়াযুল জান্নাতে বসা (নামাজ আদায় করা), জান্নাতুল বাকী যিয়ারত করা এবং মদীনার মসজিদে নামাজ জামাতে আদায় করাসহ বহু ঐতিহাসিক স্থান তথা উহুদ পাহাড় ও বদর প্রান্তর দেখার সৌভাগ্য অর্জন করে থাকেন।
হজ্বের ফজিলত: হজের অনেক পার্থিব ও পরলৌকিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন হজের সময় সারা বিশ্বের মুসলমানগণ একই স্থানে সমবেত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ হয় এবং পরস্পরের মধ্যে ভেদাভেদ দূর হয়। মুসলমানের রক্ত, বর্ণ, ভাষা ও ভৌগোলিক সীমারেখার ভিন্নতা ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ তৈরী হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামাজিক বন্ধন তৈরীর চুড়ান্ত স্তর হচ্ছে পবিত্র হজ। হজ পালনের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ, সামাজিক সম্প্রীতি তৈরী হয়। দুর হয় ধনী-গরীব সাদা-কালো, দেশপার্থক্য ও জাতীয়তার বিভেদ। হজের মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝে ঈমানী স্পৃহা ও ইসলামী চেতনা সৃষ্টি হয়। আল্লাহর সর্বভৌমত্বের ঐতিহাসিক আবেদন সৃষ্টি হয়। ইসলামি জাগরণের এক মহা সাড়া পড়ে। এবং হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর ঐতিহাসিক কুরবানি ও ত্যাগের চিত্র সকলের মনে ভেসে ওঠে।
অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলতা আসে। এ প্রসংঙ্গে আল কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- “দূর-দূরান্ত থেকে যারা এসে উপস্থিত হয়, তা তাদেরই উপকারে নিমিত্ত (সূরা হজ- ২৯)।” আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হজ ও ওমরাহ সফরে এই বৈশিষ্ট্য রেখেছেন যে, দূর-দূরান্ত থেকে হজে আগমন করতে তাদের যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তার কারণে তাদের পার্থিব দারিদ্র্য ও উপবাসে নিমজ্জিত হতে হয় না; বরং কোন কোন বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, হজ ও ওমরায় ব্যয় করলে দারিদ্র্যতা ও অভাবগ্রস্ততা দূর হয়ে যায়। হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত এক হাদিছে রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্যে হজ করে এবং তাতে অশ্লীল ও গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে হজ থেকে এমতাবস্থায় ফিরে আসে, যেন সে আজই মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়ে এসেছে; অর্থাৎ জন্মের অবস্থায় শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, সে-ও তদ্রুপই হয়ে যায়। (বোখারী, মুসলিম)
অন্য হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, হজ্জে মাবরুর বা কবুল হজের বিনিময় হলো জান্নাত। (মিশকাত) এক সাহাবি রাসুল (সা.)কে জিজ্ঞেস করলেন, সর্বোত্তম আমল কোনটি? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনয়ন। সাহাবি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কোনটি? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ। সাহাবি আবারো জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কোনটি? রাসুল (সা.) বললেন, মাবরুর হজ। (মিশকাত)
হজ পালন করলে আল্লাহর নির্দেশ পালন করা হয়। এতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সন্তুষ্ট হন। রাসুল (সা.) বলেছেন, প্রকৃত হজের পুরস্কার বেহেশত ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যারা হজ পালন করবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের হজ কবুল করবেন এবং তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত রহমত ও বরকত।
হজ্ব না করার পরিণতি: এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’লা কঠিন হুশিয়ারি উচ্ছারণ করে বলেছেন, যে লোক তা মানেনা (তার জেনে রাখা উচিত) আল্লাহ পৃথিবীর কোন কিছুই পরোয়া করেন না।” (সুরা: আলে ইমরান ঃ ৯৭) সুতরাং হজ ফরজ হয়ে গেলে বিলম্ভ না করে সাথে সাথে আদায় করে নেওয়া উচিত। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে “যে ব্যক্তির মক্কা শরীফ যাতায়াতের সম্বল সামর্থ রয়েছে কিন্তু হজ আদায় করেনি, সে যেন ইহুদী বা খৃষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করে।” (মুসলিম) অর্থাৎ- সে যেন মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করার আশা না করে। হযরত ওমর (রা:) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন: সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা হজ করে না তাদের ওপর জিযিয়া কর আরোপ করতে ইচ্ছে হয়; কারণ তারা, মুসলমান নয়। (তাফসিরে মা’রিফুল কুরআন)
-------------------------------------------------------
মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
শিক্ষক : জামেয়া ইসলামিয়া আনওয়ারে মদিনা, ইসলামপুর, সিলেট।
হজ্ব আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ- ইচ্ছা করা, সাক্ষাত, সফর, ভ্রমণ করা। শরিয়তের পরিভাষায় হজ বলা হয়- নির্ধারিত স্থানে (কাবা গৃহ প্রদক্ষিণ, আরাফাত ও মুজদালাফায় অবস্থান ইত্যাদি) নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ কিছু ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করা। কাবাঘরে সর্বপ্রথম হজ আদায় করেন হযরত আদম (আ.)। তারপর হযরত নূহ (আ.)সহ অন্যান্য নবী-রাসূলগণ এ দায়িত্ব পালন করেন। ইব্রাহিম (আ:) এর সময় থেকে হজ ফরয বা আবশ্যকীয় ইবাদত হিসেবে নির্ধারিত করা হয়। আল্লাহর হুকুমে হযরত ইব্রাহিম (আ:) সিরিয়া থেকে হিযরত করে কাবা শরীফের অদূরে নির্জন ভুখন্ডে আসেন। সে সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইব্রাহিম কে তিনটি নির্দেশ দেন।
১. আমার ইবাদাতে কাউকে শরীক করো না।
২. আমার গৃহকে (কাবা গৃহকে) পবিত্র রাখো।
৩. মানুষের মধ্যে ঘোষণা করে দাও যে, বায়তুল্লাহর হজ তোমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে। আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- “মানুষের মধ্যে হজের জন্য ঘোষণা প্রচার করো। তারা আসবে পায়ে হেটে এবং সর্বপ্রকার বাহনে সোওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে (সূরা হজ- ২৮)।” এ আদেশের পর হযরত ইব্রাহিম (আ:) মাকামে ইব্রাহীমে দাড়িয়ে উচ্ছ কণ্ঠে ঘোষণা করেন। কোন কোন বর্ণনায় হযরত ইব্রাহীম (আ:) আবু কোবাইস পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে অঙ্গুলি রেখে ডানে-বামে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে ঘোষণা করেছিলেন: “লোক সকল, তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর এই গৃহের হজ ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন করো”। এই বর্ণনায় আরো উল্লেখ আছে যে, হযরত ইব্রাহিম এর ঘোষণাটি স্রষ্টার পক্ষ থেকে বিশ্বের সবখানে পৌঁছে দেয়া হয়। শুধু তখনকার সময়ের জীবিত মানুষ পর্যন্ত নয়; বরং ভবিষ্যতে কেয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীতে আগমনকারী ছিল, তাদের সবার কান পর্যন্ত হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর এ ঘোষণার আওয়াজ পৌছে দেয়া হয়। যার যার ভাগ্যে আল্লাহ হজ লিখে দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই এই আওয়াজের জবাবে “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক” বলেছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন: ইব্রাহীমি আওয়াজের জওয়াবই হচ্ছে হজে ‘লাব্বাইকা’ বলার মূল ভিত্তি। (তাফসিরে মা’রিফুল কুরআন)
রাসূল (সা.)এর কাছে ৯ম হিজরীতে হজ্ব ফরজ হওয়ার আয়াত অবতীর্ণ হয়। তবে কেউ কেউ ৫ম, ৬ষ্ঠ হিজরীতে উম্মাতে মুহাম্মাদী (সা.) এর উপর হজ ফরজ হওয়ার কথা বলেছেন। জিলহজ্ব মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ হজের জন্য নির্ধরিত সময়। হজ্ব বিশ্ব মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন তথা মহা সম্মেলন। হজ্বের জন্য প্রতি বছর সারা বিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান কাবা শরীফে এসে সমবেত হন। সবার কন্ঠে একই আওয়াজ- “লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।” অর্থ- “আমি হাজির তোমার সান্নিধ্যে, হে আল্লাহ! আমি হাজির তোমার দ্বারে, আমি হাজির তোমার দরজায়, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির তোমার দরগায়। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও সব নিয়ামত তোমারই, আর তোমার রাজ্যে তোমার কোনো অংশীদার নেই।” এভাবেই আল্লাহর ঘরের মেহমানরা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে উপস্থিতির আকুতিপূর্ণ বিনীত ঘোষণা করেন।
হাজিগন মক্কা শরিফে কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা ইত্যাদি বরকতময় স্থানে অবস্থান করে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করেন। হজের পূর্বে অথবা পরে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) এর উম্মতগণ মদীনা শরীফে যান এবং রাসূলে পাক (সা.) এর রওজা মোবারক যিয়ারত, রিয়াযুল জান্নাতে বসা (নামাজ আদায় করা), জান্নাতুল বাকী যিয়ারত করা এবং মদীনার মসজিদে নামাজ জামাতে আদায় করাসহ বহু ঐতিহাসিক স্থান তথা উহুদ পাহাড় ও বদর প্রান্তর দেখার সৌভাগ্য অর্জন করে থাকেন।
হজ্বের ফজিলত: হজের অনেক পার্থিব ও পরলৌকিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন হজের সময় সারা বিশ্বের মুসলমানগণ একই স্থানে সমবেত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ হয় এবং পরস্পরের মধ্যে ভেদাভেদ দূর হয়। মুসলমানের রক্ত, বর্ণ, ভাষা ও ভৌগোলিক সীমারেখার ভিন্নতা ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ তৈরী হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামাজিক বন্ধন তৈরীর চুড়ান্ত স্তর হচ্ছে পবিত্র হজ। হজ পালনের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ, সামাজিক সম্প্রীতি তৈরী হয়। দুর হয় ধনী-গরীব সাদা-কালো, দেশপার্থক্য ও জাতীয়তার বিভেদ। হজের মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝে ঈমানী স্পৃহা ও ইসলামী চেতনা সৃষ্টি হয়। আল্লাহর সর্বভৌমত্বের ঐতিহাসিক আবেদন সৃষ্টি হয়। ইসলামি জাগরণের এক মহা সাড়া পড়ে। এবং হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর ঐতিহাসিক কুরবানি ও ত্যাগের চিত্র সকলের মনে ভেসে ওঠে।
অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলতা আসে। এ প্রসংঙ্গে আল কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- “দূর-দূরান্ত থেকে যারা এসে উপস্থিত হয়, তা তাদেরই উপকারে নিমিত্ত (সূরা হজ- ২৯)।” আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হজ ও ওমরাহ সফরে এই বৈশিষ্ট্য রেখেছেন যে, দূর-দূরান্ত থেকে হজে আগমন করতে তাদের যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তার কারণে তাদের পার্থিব দারিদ্র্য ও উপবাসে নিমজ্জিত হতে হয় না; বরং কোন কোন বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, হজ ও ওমরায় ব্যয় করলে দারিদ্র্যতা ও অভাবগ্রস্ততা দূর হয়ে যায়। হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত এক হাদিছে রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্যে হজ করে এবং তাতে অশ্লীল ও গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে হজ থেকে এমতাবস্থায় ফিরে আসে, যেন সে আজই মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়ে এসেছে; অর্থাৎ জন্মের অবস্থায় শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, সে-ও তদ্রুপই হয়ে যায়। (বোখারী, মুসলিম)
অন্য হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, হজ্জে মাবরুর বা কবুল হজের বিনিময় হলো জান্নাত। (মিশকাত) এক সাহাবি রাসুল (সা.)কে জিজ্ঞেস করলেন, সর্বোত্তম আমল কোনটি? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনয়ন। সাহাবি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কোনটি? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ। সাহাবি আবারো জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কোনটি? রাসুল (সা.) বললেন, মাবরুর হজ। (মিশকাত)
হজ পালন করলে আল্লাহর নির্দেশ পালন করা হয়। এতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সন্তুষ্ট হন। রাসুল (সা.) বলেছেন, প্রকৃত হজের পুরস্কার বেহেশত ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যারা হজ পালন করবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের হজ কবুল করবেন এবং তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত রহমত ও বরকত।
হজ্ব না করার পরিণতি: এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’লা কঠিন হুশিয়ারি উচ্ছারণ করে বলেছেন, যে লোক তা মানেনা (তার জেনে রাখা উচিত) আল্লাহ পৃথিবীর কোন কিছুই পরোয়া করেন না।” (সুরা: আলে ইমরান ঃ ৯৭) সুতরাং হজ ফরজ হয়ে গেলে বিলম্ভ না করে সাথে সাথে আদায় করে নেওয়া উচিত। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে “যে ব্যক্তির মক্কা শরীফ যাতায়াতের সম্বল সামর্থ রয়েছে কিন্তু হজ আদায় করেনি, সে যেন ইহুদী বা খৃষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করে।” (মুসলিম) অর্থাৎ- সে যেন মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করার আশা না করে। হযরত ওমর (রা:) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন: সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা হজ করে না তাদের ওপর জিযিয়া কর আরোপ করতে ইচ্ছে হয়; কারণ তারা, মুসলমান নয়। (তাফসিরে মা’রিফুল কুরআন)
মৃত্যু কখনজানি এসে যায়! সম্পদ কখনজানি বিলীন হয়ে যায়! হজ করার জন্য আর্থিক সামর্থ থাকার পাশাপাশি শারিরিক শক্তি ও সামর্থ থাকাও জরুরী। এমনও হতে পারে বিলম্ব করার কারণে আপনি অসুস্থ হয়ে যাবেন কিংবা আর্থিক সামর্থ নাও থাকতে পারে। হজ্ব ফরজ হওয়ার পর যদি পরবর্তীতে কোনো ব্যক্তি সম্পদহারা হয়ে যায়; তবে তার ওপর ফরজ হজ্ব আদায়ের হুকুম রহিত হবে না। হজ্ব ফরজ থাকা অবস্থায় যদি মৃত্যু হয় তাহলে পরিণতি ভাল হবে না। তাই হজ্ব ফরজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আদায় করে নিতে হবে। যদি আদায় না করেন, তাহলে হাদীসে উল্লেখিত পরিণতি তাকে ভোগ করতে হবে। তাই হজ্ব ফরজ হওয়ার পর অনতিবিলম্বে তা আদায় করা একান্ত জরুরি।
হজের সময় বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা গড়ে ওঠে। মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝে ঐক্য ও সংহতি স্থাপিত হয়। আল্লাহ তায়ালার সন্তুুষ্টি অর্জন ত্বরান্বিত হয়। ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি অর্জনের পথ সুগম হয়। আল্লাহ তা’লা আমাদেরকে সঠিক সময়ে হজ্ব করার এবং জীবনে বারবার হজ্ব আদায়ের তাওফীক দান করুন। আমীন।-------------------------------------------------------
মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
শিক্ষক : জামেয়া ইসলামিয়া আনওয়ারে মদিনা, ইসলামপুর, সিলেট।
No comments:
Post a Comment