মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Thursday, August 9, 2018

পবিত্র হজ্জঃ বিশ্ব মুসলিমের একত্ববাদের দৃপ্ত ঘোষনা


“মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই,” হাদীসের এ কথাটির বাস্তবতা পুরামাত্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় হজ্জ পালনের মাঝে। ডঃ লেনার এ ব্যাপারে বলেছেন: “হজ্জের মৌসুমে প্রদর্শিত ঐক্যবোধের প্রকাশ এতই পূর্ণাঙ্গ যে, এখানে প্রভু ও ভৃত্যের পার্থক্য করা অসম্ভব ব্যাপার। সমগ্র মুসলিম জাতি এক আকৃতি, এক দৃষ্টি ভঙ্গি গ্রহণ করে এবং তাতে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের মহত্তম দৃশ্য লক্ষগোচর হয়।”
--------------------------------------------------------------
লিখেছেন - সেলিম সামীর
--------------------------------------------------------------
ইসলামের ফরজ রুকনগুলোর মধ্যে অন্যতম রুকন ‘হজ্জ’। মুসলমানদের মধ্যে সামর্থবান ব্যক্তিদের উপর হজ্জ ফরজ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে: “এবং আল্লাহর জন্য এই ঘরের (কাবা ঘরের) হজ্জ পালন করা তাদের উপর আবশ্য কর্তব্য, যারা এখানে পৌছাতে সক্ষম। আর যে লোক তা মানেনা (তার জেনে রাখা উচিত) আল্লাহ পৃথিবীর কোন কিছুই পরোয়া করেন না।” (সুরা: আলে ইমরান : ৯৭)

পবিত্র কোরআনের উক্ত আয়াত দ্বারা হজ্জের হুকুম স্পষ্টই প্রতিয়মান। হজ্জ ব্যাপক বৈশিষ্টসম্পন্ন মৌলিক ইবাদতগুলোর মধ্যে অন্যতম। মুলত: অন্যান্য ইবাদতের মৌলিক বৈশিষ্টসমুহ হজ্জের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এতে পাওয়া যায় নামাজ আদায়ের প্রতি তীব্র অনুরাগ, সামাজিক হৃদ্যতা, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সময়ানুবর্তিতা ও আধ্যাত্মিক প্রশান্তি। আরোও পাওয়া যায় নির্দিষ্ট খারাপ কাজ বর্জন এবং যাকাতের আর্থিক ত্যাগ সহ বহু ইবাদতের মৌলিক সারবস্তু। হজ্জ মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ ও সংহতি স্থাপন করে। মুসলমানগণকে শিক্ষা দেয় একই স্থানকে কেন্দ্রবিন্দু করে (কাবা ঘরকে) সেনাবাহিনীর মত সুশৃংখল ভাবে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে আল্লাহর একত্ববাদের আওয়াজকে বুলন্দ করার। মুসলমানরা একই জাতি-সংঘের মানুষ হয়ে আল্লাহর খিলাফত কায়েম করার।

মানুষ হচ্ছে সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ না হয়ে তারা বাস করতে পারে না। আর সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে হলে প্রয়োজন সামাজিক সম্প্রীতি, ঐক্য। আর এ সামাজিক সম্প্রীতি তৈরী করা হয় পারস্পরিক সাক্ষাৎ, কুশল বিনিময় ও ভাবের আদান প্রদানের মাধ্যমে। ইসলামী জীবনাদর্শ তথা জীবন বিধান সেই বন্ধন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তৈরী ও প্রতিষ্ঠার সঠিক ক্ষেত্র এবং উপায় প্রদান করেছে। এর প্রাথমিক স্তর হচ্ছে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায়। এর মাধ্যমে পাড়া-পড়শি এবং গ্রামের প্রতিটি সদস্যের সম্মিলন ঘটে। পরস্পরে কুশল বিনিময় হয়; ভাবের আদান প্রদান হয়; যার মাধ্যমে গড়ে উটে পারস্পরিক ভালোবাসা, সহমর্মিতা, সামাজিক সম্প্রীতি ও বন্ধন। এভাবে সামাজিক বন্ধন তৈরীর কার্যক্রমের আরও বিস্তৃতি ঘটে জুমা বারে জামে মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ তথা সাপ্তাহিক ঈদ এবং দুই ঈদের নামাজ এলাকার বড় মাঠে গিয়ে পালন করার মাধ্যমে। বস্তুত: এগুলোর সর্বত্রই ঘটে স্থানীয় ভাবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামাজিক বন্ধন তৈরীর চুড়ান্ত স্তর হচ্ছে পবিত্র হজ্জ। হজ্জ পালনের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ, ঐক্য, সংহতি ও সামাজিক সম্প্রীতি তৈরী হয়। হজ্জের এ মহা সম্মিলনে একত্রিত হয় বিশ্বের সকল দেশের বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মুসলমান। তাদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান হয়; একে অন্যের কাছে পরিচিত হয়ে উঠে; তৈরী হয় বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব; দুর হয় ধনী-গরীব সাদা-কালো, দেশপার্থক্য ও জাতীয়তার বিভেদ। হজ্জের মত এমন বিশ্বজনীন ঐক্য, সম্প্রীতি, সংহতি তৈরীর সুন্দর ব্যবস্থা পৃথিবীর অন্য কোন ধর্মে অত্যন্ত বিরল।

বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য তৈরীতে হজ্জের এ ভুমিকাকে প্রত্যক্ষ করেই খৃষ্টান লেখক P.K hittry তার History of the arabs বইতে উল্লেখ করেছেন :

“Of all world religion seems to have attained the largest measure of success in distinastion the barriers of race. colour and nationality at least with in the countries of its own community.”

“পৃথিবীর সকল ধর্মের মধ্যে একমাত্র ইসলামই নিজেদের দেশ- জাতির মধ্যে বংশ, রং, ও জাতীয়তাবাদের সকল বৈষম্য দূর করে বড় ধরণের সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়।”

সামাজিক বন্ধন ও সম্প্রীতি সৃষ্টির এরুপ মহা সম্মিলন আর কোথায় খুজে পাওয়া যাবে? এ সম্মিলনে প্রথিবীর সকল অংশের সকল শ্রেণীর মুসলমান একই পোষাক পরে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিয়ে একই কথা বলে: “আল্লাহম্মা লাব্বাইক...........লা শারীকা লাক।”

“মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই,” হাদীসের এ কথাটির বাস্তবতা পুরামাত্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় হজ্জ পালনের মাঝে। ডঃ লেনার এ ব্যাপারে বলেছেন:
“হজ্জের মৌসুমে প্রদর্শিত ঐক্যবোধের প্রকাশ এতই পূর্ণাঙ্গ যে, এখানে প্রভু ও ভৃত্যের পার্থক্য করা অসম্ভব ব্যাপার। সমগ্র মুসলিম জাতি এক আকৃতি, এক দৃষ্টি ভঙ্গি গ্রহণ করে এবং তাতে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের মহত্তম দৃশ্য লক্ষগোচর হয়।”

এ ব্যাপারে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মোহাম্মদ আলী বলেছেন:
“Noother institution in the world has the wonderful influence of the hajj in leaving distination of race colour and rank.”

“বংশ, ধর্ম ও পদমর্যাদার সকল বৈষম্য দূর করে সব মানুষের মাঝে সাম্য বিধানের ব্যাপারে হজ্জের মত শক্তিশালী প্রভাব অন্য কোন বিধানে নেই।”

হজ্জ মানুষকে সুশৃংখল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হওয়ার শিক্ষা দেয়। ইহরাম বেধে লাব্বাইক আল্লাহম্মা লাব্বাইক বলার অর্থ আল্লাহর আহব্বানের সাড়া দিয়ে তার একত্ববাদের দৃপ্ত ঘোষণা দিয়ে সুশৃংখলভাবে নিজেকে একান্ত অনুগত সৈনিক হিসেবে আল্লাহর সামনে পেশ করা। প্রয়োজনবোধে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য ঐরূপ সুশৃংখল জীবন যাপন করার মাধ্যমে আত্মোৎসর্গে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।

সাফা মারওয়া সায়ী করার দ্বারা হাজীকে একথা প্রমাণ করতে হয় যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সব সময় এরকম দৌড়াতে প্রস্তুত থাকবো। এ সায়ীর সময় হাজীরা বলেন: “হে আল্লাহ! আমাকে তোমার নবীর আদর্শ ও রীতি অনুযায়ী কাজ করার তাওফিক দাও, তোমার নবীর পথেই আমাকে মৃত্যু দিও, আর পথভ্রষ্টকারীর ফিতনা থেকে আমাকে রক্ষা করো।”

এরপর রয়েছে পাথর নিক্ষেপের কার্যক্রম। এর দ্বারা এ কথা প্রমাণ করতে হয় যে, ইসলামের ধ্বংস ও ক্ষতি করার জন্য যে-ই চেষ্টা করুক না কেন আমি তার বিরুদ্ধে এমনি ভাবে যুদ্ধ করবো। এরপর রয়েছে কোরবাণী। এই কোরবাণী আল্লাহর রাস্তায় স্ত্রী-সন্তান সহ নিজের জীবন বিসর্জন দেয়ার বাসনার বাস্তব প্রমাণ। পশু কোরবাণী দিয়ে হাজীগণ এ কথাই প্রমাণ করেন যে, ইবরাহীম (আ.) যেভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রাণপ্রিয় পুত্র কোরবাণী ুকরতে তার গলায় ছুরী চালাতে দ্বিধাবোধ করেননি। তেমনিভাবে আমিও এই পশু কোরবাণীর মাধ্যমে এ কথা প্রমাণ করতে চাই যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্ত্রী-সন্তানসহ আত্মোৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করবোনা।

হজ্জের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হচ্ছে, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। এই ময়দান থেকে বিজ্ঞ এবং সার্বিক জ্ঞানসম্পন্ন ইসলামী নেতৃবৃন্দরা সারা বিশ্বের মুসলমানদের দিক-নির্দেশনা দিবেন। যে দিক-নির্দেশনায় থাকবে তাদের সামাজিক, আত্মিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক, সাংস্কৃতিক দিকসহ নানা জীবনাচরণের সার্বিক সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত সমাধান। যেমনিভাবে সেনাবাহিনীকে হেডকোয়ার্টার থেকে দেয়া হয়ে থাকে তাদের জন্য সার্বিক দিক-নির্দেশনা।

যেহেতু মুসলমানরা একই ভ্রাতৃ-সংঘের সদস্য, একই প্লাটফরমের সৈনিক। তাই তারা আরাফাতের ময়দানের এ দিক-নির্দেশনার আলোকে পৃথিবীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে নিজেদের মিশন নিয়ে। এ নির্দেশনা অনুযায়ীই পৃথিবীব্যাপী কাজ চালিয়ে যাবে। সুতরাং আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দ্বারা এটাই শিক্ষা দেয়া উদ্দেশ্য যে, হে মুসলমানগণ! তোমরা এখান থেকে চলে যাবার অর্থ এই নয় যে, তোমরা আলাদা হয়ে যাচ্ছ, বরং তোমরা একটি মিশন নিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছো। আর সে মিশন হচ্ছে, তাওহীদ ও একত্ববাদের ঝান্ডাকে পৃথিবীর বুকে সমুন্নত করার মিশন।

আরাফাতের ময়দানে দিকনির্দেশনা দানের বাস্তব প্রমাণ আমরা রাসূল (সা.) এর বিদায় হজ্জের ভাষণ থেকে পাই। যে দিক-নির্দেশনামুলক ভাষণ ইসলামের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আরাফাতের ময়দান থেকে এরুপ দিক-নির্দেশনা মুসলমানদের দেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে যে ভাষণ সেখানে দেওয়া হয়, তাতে কি অদৌ কোন দিক-নির্দেশনা থাকে? অথচ তেমনটি হলে মুসলমানদের মত এত মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো না। মুসলমানদের মধ্যে থাকতোনা এতো অনৈক্য, এতো বিশৃঙখলা। হজ্জের মত এমন একটি মহা সম্মিলন যা ব্যতিত বিশ্বজনীন ঐক্য-ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি হতে প্রথিবীর বুকে দ্বিতীয় আর কোন পথ খোলা নেই, তা থাকা সত্বেও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের এতো অভাব কেন? কেন আজ বিশ্বের মুসলমানরা এতো দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে? নিজেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের এতো সুন্দর ক্ষেত্র থাকা সত্বেও তাদের এতো ব্যর্থতা? আজ যখন এ হজ্জব্রত পালনের সময় এসেছে, এসেছে ঈসমাইলী কোরবানীর ডাক, তখন বিশ্ব মুসলিম এক ভয়ংকর দুর্যোগময় মুহুর্ত অতিক্রম করছে। মুসলমানদের জীবনই যেন আজ পৃথিবীর সবচাইতে সস্তা বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই গ্লানিকর বিপর্যয়ের কারণ খতিয়ে দেখতে হলে প্রতিপক্ষের উপর দোষ চাপানোর আগে আত্বানুসন্ধান করার প্রয়োজন রয়েছে।

আসলে বংশানুক্রমিকভাবে মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় মৌলিক ইবাদতগুলো রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে পালন করছে মাত্র; এগুলোর আন্তর্নিহিত তাৎপর্য, হিকমত, প্রগাঢ় রহস্য ও কল্যাণকামীতাকে জেনে-বুঝে নয়। কখনও এগুলোর স্বরূপ সন্ধান করার প্রয়োজন বোধও করেনি। নিজের পূর্ববর্তীদের দেখাদেখি হজ্জসহ ইসলামের সকল ইবাদতের কার্যক্রমের নকল করে যাচ্ছে তারা। তাই এগুলোর অন্তর্নিহিত কল্যাণ তাদের কোন উপকার করতে পারছেনা। ইবাদতগুলোর বাহ্যিক রুপ বজায় থাকছে, কিন্তু এর তাৎপর্য ও লক্ষ্য উদ্দেশ্যের দিকে দৃষ্টি না থাকায় এর দ্বারা কোন প্রাণশক্তি সৃষ্টি হচ্ছে না।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে: মুসলমানরা ব্যাপারটি অনুধাবন করতে না পারলেও ভিন্নধর্মী চিন্তাশীল ব্যাক্তিরা তা ভাল করেই বোঝেন। এ ব্যাপারে প্রফেসর Hurgronic বলেন:-

“The idial of a league human race has been indeed approached by islam more hear by them by any other religion for the league of nations indeed on the best of Muhammad (s) religion takes the principle of ecuality of all humen races. So seriously as to put other communities to shame.”

“ইসলাম মানব জাতির জন্য একটি সংগঠন যত সহজে তৈরী করেছে, অন্য কোন ধর্ম তা করতে পারেনি। মোহাম্মদ (সা.) গঠন করা জাতিসংঘ প্রথিবীর সকল মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এমন মৌলিক ও উন্নত একতা সৃষ্টি করেছে, যা অন্য ধর্মের জন্য সত্যিই এক লজ্জাস্কর ব্যাপার।”

আল্লাহ পাক আমাদেরকে হজ্জসহ ইসলামের মৌলিক সকল ইবাদতসমুহের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, হিকমত ও এগুলোর আর্থ-সামাজিক প্রভাব উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
-------------------------------------------------------------------------------------------------

No comments:

Post a Comment

Pages