মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Wednesday, August 8, 2018

সড়কে ঝরবে আর কত প্রাণ?

সড়কের নৈরাজ্য ফুটে উঠেছে কার্টুনিস্ট শিশিরের এই কার্টুনে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা ইনিষ্টিটিউটের গবেষণা বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। শতকরা ৯০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতি আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে। এছাড়া যানবাহনে ত্রুটি, পরিবেশ পরিস্থিতি ও অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ১০ শতাংশ। 
-------------------------------------------------------
লিখেছেন - মাওলানা আবদুল হামিদ
========================
“বাস মামা আসতে চালাও, মরে গেলে মা কাঁদবে”- এমন আকুঁতি নিবেদন লিখা একটি প্লে-কার্ড নিয়ে ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয়া এক শিশু দাড়িয়ে ছিল রাজধানীর রাজপথে। তার আকুঁতিপূর্ণ এই শ্লোগান দেখে হৃদয় কেঁপে উঠল। সন্তানহারা মায়ের অশ্রæ নিবারণের সাধ্য আছে কারো? যেই মায়ের কূল খালি হয়, সেই মা-ই বুঝেন সন্তান হারানোর যন্ত্রণা। কতটা ব্যাথিত আর অসহায় হলে এমন আকুঁতি নিয়ে রাস্তায় দাড়াতে পারে একটা শিশু? শিশুরা দেখেছে, তাদের সহপাঠি নিহত হওয়ার পর নিহতের মা কিভাবে কেঁদেছেন। সে বুঝতে পারছে যে, সে মারা গেলে তার মা-ও এভাবে কাঁদবেন। যে কোন বিবেকবানের হৃদয় আকৃষ্ট হওয়ার জন্য এই একটি শ্লোগানই যথেষ্ঠ।

এমন কোন দিন আছে যে দিন কোন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেনি? কোন অকাল মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি? আমরা প্রতিদিন দুর্ঘটনার নিউজ পড়ি। গণমাধ্যমগুলোতে রক্তে-রঞ্জিত, ক্ষত-বিক্ষত লাশের ফটো, ভিডিও দেখি। দেখি দুর্ঘটনা কবলিত যানবাহনের দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ছবি। উসমানি নগরে ট্রাক-মাইক্রোবাস মুখোমুখি সংঘর্ষে বর, শিশুসহ সাতজন নিহত হওয়ার নিউজ দেখে আমরা মর্মাহত হয়েছি। আমরা মর্মাহত হয়েছি, গত ২৯ জুলাই রবিবার রাজধানীর কুর্মিটোলার এয়ারপোর্ট রোডে জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় মিম ও রাজিব নামের দুই কলেজ শিক্ষার্থীর নিহত হওয়ার চিত্র দেখে। আমরা মর্মাহত হয়েছি, ৩১ জুলাই মঙ্গলবার কুমিল্লায় স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা তিন শিক্ষার্থীর ওপর বালুবাহী ট্রাক উঠিয়ে দেয়া দেখে। এতে ঘটনাস্থলেই আকলিমা আক্তার নামের দশম শ্রেণির এক ছাত্রী নিহত হয়েছেন। এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন একই শ্রেণির আরও দুই শিক্ষার্থী। উদাহরণত দু’একটির কথা লিখলাম। এমন শত শত ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। সড়কে ঝরছে হাজারো তাজা প্রাণ। শত স্বপ্নের সমাধি হচ্ছে পিচঢালা সড়কে রক্ত ঝরিয়ে। কত মায়ের কূল খালি হচ্ছে সড়কে চালকদের অসুস্থ অশুভ আচরণে। সন্তান হারা মায়ের হৃদয়বিদারক আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। তার পরেও সড়কের অসুস্থতা কমছেনা; বরং দিন দিন বেড়েই চলছে। সড়কে গত সাড়ে তিন বছরে প্রায় ২৫ হাজার প্রাণহাণি। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক হিসাবে গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৬ হাজারেরও বেশি। এবারের হিসাবে এ সংখ্যা হয়তো আরো অনেক বেশি হবে। কারণ, প্রতিদিনই একাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে এবং আহত-নিহতের সংখ্যাও দুইয়ের কোঠার দেখা যায়। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। গত ৪ আগস্ট দৈনিক ইনকিলাবের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নিরাপদ সড়ক চাই এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি জানুয়ারী মাস থেকে জুন পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে ১৫৪৯ টি। এতে আহত হয়েছেন ৩৮৩১ জন। নিহতের সংখ্যা ১৮৮৩ জন। অন্য এক পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা গেছে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ২৮৬০ টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩০২৬ জন। আহত হয়েছেন ৮৫২০ জন। দুর্ঘটনায় নিহতদের বেশিরভাগই তরুণ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় হাজার হাজার মেধাবী ও কর্মক্ষম জনশক্তি হারিয়ে দেশের অপুরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।

আমরা এসব ঘটনায় মর্মাহত হই, দুঃখ প্রকাশ করি। এতেই কী দায়-দায়িত্ব শেষ? কেন হচ্ছে এসব? সড়কে মৃত্যুর মিছিল কেন থামছে না? এতে কি কারো মাথা ব্যাথা আছে? কেউ কি আছেন চালকদের নিয়ন্ত্রণ করার? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গত কয়েকদিনের আন্দোলনে ছাত্ররা চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, যারা এসব নিয়ন্ত্রণ করার কথা, তারা বেখবর। তাদের গাড়ীর কাগজ নাই, চালকের লাইসেন্স নাই, তারাও লেন ছাড়া উল্টো পথে চলেন ইত্যাদি, এমন সব অনিয়ম নিয়ম প্রয়োগকারীদের মাঝে। বিক্ষোভরত এক শিক্ষার্থীর প্লে-কার্ডে লিখা ছিল, “রাস্তা সাময়িক বন্ধ আছে, রাষ্ট্র সংস্করণের কাজ চলছে।” -আসলেই তো, যেসব অনিয়ম দেখিয়ে দিল ছাত্ররা তার সংস্করণ জরুরী। যারা আইন প্রয়োগ করবেন তারাও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া দরকার। দায়িত্বশীলসহ সকল নাগরিক যদি নিজ থেকে সবাই সচেতন হন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, তাহলে দেশে কোন অনিয়ম থাকবে না।
গত ৩ আগস্ট কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সারা দেশে এখন ত্রæটিপূর্ণ ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। আর যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা নয় লাখ কম। অর্থাৎ, নয় লাখ যানবাহন চালাচ্ছেন অদক্ষ লাইসেন্সহীন ভোয়া চালক। একদিকে ভোয়া অদক্ষ লাইসেন্স বিহীন চালক আর অপর দিকে ত্রুটিপূর্ণ  যানবাহন। এই দুইয়ে মিলে সড়ক-মহা সড়ক অনিরাপদ করে তুলেছে। ঐ প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা ইনিষ্টিটিউটের গবেষণা বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। শতকরা ৯০ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতি আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে। এছাড়া যানবাহনে ত্রুটি, পরিবেশ পরিস্থিতি ও অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ১০ শতাংশ। (সুত্র- প্রথম আলো, ৩ আগস্ট, ২০১৮ ইংরেজি) লাইসেন্সহীন অদক্ষ চালকরা যখন লক্কড়ঝক্কড়, চ্যাপা, রং নেই, গ্লাস ভাংগা, পোড়া গন্ধ এমন যানবাহন বেপরোয়া গতীতে চালান, তখন দুর্ঘটনা ঘটবে না তো কী?

সড়ক ও পরিবহন কত মায়ের নাড়ি ছেড়া ধন কেড়ে নিয়েছে। কত সন্তান বাসা থেকে হাসিমুখে বের হয়ে ফিরেছে সড়কের বলী হয়ে। স্বজনদেরে শোকের সাগরে ভাসিয়ে লাশ হয়ে। সেদিন হানিফ পরিবহনের এক যাত্রী বাসে উঠার সময় গুরুতর আহত হলে তাকে নদীতে ফেলে চলে গেলেন বাসের চালক ও কর্মচারিরা। কয়েকদিন পরে নদীতে ভেসে উঠল পচে যাওয়া গলে যাওয়া লাশ। স্বজনরা তার লাশ দেখে ঠিকমত চিনতেও পারছিলেন না। নিহতের মা চিৎকার করে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন- “আমার ছেলেকে নদীতে না ফেলে রাস্তায় ফেলে গেলেও বেঁচে যেত।” এমন ঘটনা আমাদের সোনার বাংলায় প্রতিনিয়ত ঘটছে। সব দুর্ঘটনা শুধুই দুর্ঘটনা নয়। কিছু দুর্ঘটনা হত্যাকান্ডের চেয়েও মারাত্মক। রাজধানীর কুর্মিটোলার এয়ারপোর্ট রোডে জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় নিহত দিয়া খানমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম  নিজেই একজন বাস চালক। তিনি বলেছেন- তার মেয়ে ও মেয়ের সহপাঠি নিহত হওয়ার ঘটনাটি দুর্ঘটনা নয়। এটা হত্যাকান্ড। তিনি হত্যাকারীর ফাঁসি দাবী করেছেন। সেদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর দিয়ে পিকআপ ভ্যান চালিয়ে দিলেন এক বেপরোয়া চালক। জানা গেছে ৯৯ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনায় মামলা নেয়া হয় না। আর বাকী ১ ভাগও নানা অদৃশ্য কারণে বা আমলাতান্ত্রিক ঝটিলতায় নিস্পত্তি হয় না। তাছাড়া সড়ক আইনে কঠোর শাস্তির বিধান না থাকা, এসব কারণেই কী চালকরা এতো বেপরোয়া?

সড়কে ঝরবে আর কত প্রাণ? দুর্ঘটনা মাসে এক দুইটা হলে মেনে নেয়া যেত। প্রতিদিন ঘটছে একাধিক দুর্ঘটনা। মৃতের সংখ্যা একদিনের চেয়ে আরেকদিন বেশি হচ্ছে। এসব কি দেখার কেউ নেই? সমাজের দায়িত্বশীলরা যখন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে হাসাহাসি করেন। তখন কি আর বলার আছে! আসলেই আমাদের দুর্ভাগ্য।

ঝুকিপূর্ণ যানবাহন ও সড়ক, অদক্ষ অবৈধ লাইসেন্স বিহীন চালক, চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, চালকদের মাদক সেবন, অতিরিক্ত গতি, ট্রাফিক আইনের প্রতি উদাসিনতা, পথচারিদের অসচেতনতার কারণেই দিন দিন বাড়ছে সড়কে লাশের মিছিল। দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনে সর্বোচ্ছ শাস্তির বিধান জারি করতে হবে। শুধু বিধান থাকলেই সমাধান হবে না। যথাযথভাবে বিধান প্রয়োগ করতে হবে। সমস্যা চিহ্নিত করে এর সমাধান করতে হবে। দুর্ঘটনার ধরণ বিবেচনায় অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

--------------------------------------------------------------
মাওলানা আবদুল হামিদ
শিক্ষক : জামেয়া ইসলামিয়া আনওয়ারে মদিনা, সিলেট।
মোবাইল : ০১৭১০৩৩৭০৭৭
E-mail : hamidsylbd@gmail.com

No comments:

Post a Comment

Pages