মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Tuesday, September 18, 2018

বাংলাদেশে অতি ধনীদের উত্থান

কেউ পাঁচতলায় আর কেউ গাছতলায়

বাংলাদেশে অতি ধনীদের উত্থান


মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
-----------------------------------------
দেশে অতিধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে। ধনীদের আয় বেড়েছে, সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। অপর দিকে যারা গরীব তারা আরো গরীব হচ্ছে, তাদের আয় রোজগার কমেছে। উপরের যাত্রীর যাত্রা উপর দিকে অগ্রসর হচ্ছে আর নিচের যাত্রীর যাত্রা নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিষয়টি খুবই সাধারণ নয়। ব্যাপারটি এই দাঁড়িয়েছে যে, কেউ পাঁচ তলায় আর কেউ গাছ তলায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যে দেশের শতকরা ২৪ ভাগ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে, সে দেশে ভারসাম্যহীন পরস্পর বিপরীতমুখী অর্থব্যবস্থা সুখকর নয়। সম্প্রতি একটি পত্রিকার রিপোর্টে দেখা গেছে বাংলাদেশের অতি ধনিদের সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৭ শতাংশ। যা যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ ৭৫ টি উন্নত দেশের চেয়ে বেশি। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে দেশের সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। তাদের মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৯৪১ টাকায়। বিপরীতে একই সময়ে সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে ৫৯ শতাংশ। তাদের মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ৯৭৩ টাকায়, যা ২০১০ সালে ১ হাজার ৭৯১ টাকা ছিল। অর্থনীতিবিদরা বিষয়টিকে খুবই ইতবাচক হিসেবে দেখছেন না। কারণ একটা শ্রেণীর হাতে বড় অংশের সম্পদ কেন্দ্রীভুত হচ্ছে। ধনী-গরীবের মধ্যকার বৈষম্য বাড়ছে। বড় ধরণের ব্যবসা, বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে সরকারের কাছের লোকেরা। সাধারণ ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের পরিসর ছোট হয়ে আসছে। ফলে পুঁজিপতি বড় ব্যবসায়ীরা আরো পুঁজির মালিক হচ্ছে।
বাংলাদেশে অতিধনী বা যাদের কাছে ২৫০ কোটি টাকার চেয়ে বেশী সম্পদ রয়েছে তাদের সংখ্যা এতই বেড়েছে যে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকেও হার মানিয়েছে। কিন্তু দেশে এতো এতো বড়লোক পুঁজিপতি থাকা সত্বেও নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উটছে না, নতুন কর্মসংস্থান তৈরী হচ্ছে না, বেকারত্বের হার কমছে না, দরিদ্রজনগোষ্ঠীর দরিদ্রতার গ্লানি মুছন হচ্ছে না, ধনী-গরীবের তারতম্য কমছে না। কিন্তু কেন? কারা কিভাবে রাতারাতি সম্পদের পাহাড় গড়তে সক্ষম হলো? এসব প্রশ্ন দেশের সাধারণ জনগণের, নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের।
স্বজনতোষী পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে সমাজের কিছু লোক সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে। এ ধরণের অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি মালিকানা ও মুনাফা বন্টনের ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে। তবে বৃহত্তর জণগোষ্ঠীর কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়নি। উৎপাদন, মুনাফা অর্জন ইত্যাদির ক্ষেত্রে হালাল-হারাম ও বৈধ-অবৈধের কোন সীমা রেখা চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে অবাধ শোষণ, ও জুলুমের দ্বার উন্মুক্ত হয়। লুটপাট, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, ধোঁকা, কালোবাজারী, দ্রব্যে ভেজাল ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। মানুষের মাঝে একধরণের অনৈতিক মানসিকতা গড়ে ওঠে, চাহিদা লাগামহীন বেড়ে যায়, বাড়তি চাহিদাসৃষ্ট অভাবের তাড়নায় সমাজের সর্বত্র অবৈধ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের তৎপড়তা শুরু হয়, একশ্রেণীর মানুষের কাছে সম্পদ সঞ্চিত হতে থাকে। এরকম অর্থব্যবস্থার অশুভ আচরণে ধনী-গরীবের মাঝে একটা ফারাক বা দুরত্ব তৈরী হয়। পুঁজিপতিরা নিজের সঞ্চয়ের ভান্ডারকে আরো ভারি করার জন্য অধিনস্তদের উপর শোষণ-নির্যাতন, অশুভ আচরণ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। একক মালিকানার একচেটিয়া প্রভাবে সম্পদ আহরণে পুঁজিবাদিরা কোন রকমের বাছ-বিচার করে না। যে কোন পন্থায় চাই সম্পদ আহরণ, কুক্ষীগত করণ, পুঞ্জীভুত করণ। এমন দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাতারাতি সম্পদের পাহাড় গড়তে সক্ষম হয়। আর এর জের বহন করতে হয় সমাজের অপরাপর মানুষকে। মানবগোষ্টীর বিশাল একটি অংশকে সমাজের অর্থনৈতিক দৈন্য ও নিগ্রহের শিকার হতে হয় এবং তারা নূন্যতম প্রয়োজনগুলোও পুরণ করতে ব্যর্থ হয়। উৎপাদন ও ভোগের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা দেখা দেয়। এর ফলে সমাজে বেকারত্ব বাড়ে এবং ধনী-গরীবের বিস্তর তারমত্য সৃষ্টি হয়।
সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তি অবাধ মালিকানার অধিকার লাভ করার পরও শরিয়তের সীমারেখার মধ্যে থেকে আয়-উপার্জন ও ব্যায় করতো, সুদ, ঘুষ, জুয়া, প্রতারণা ও সকল প্রকার হারাম লেনদেন পরিহার করতো, বাজার ব্যবস্থার উপর দখলদারিত্ব থেকে বিরত থাকতো, মানুষের মাঝে সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সদাচারণের মাধ্যমে পরোপকারের চেতনা থাকতো, তাহলে ধনী-গরীবের মধ্যে এতো তারতম্য সৃষ্টি হতো না। একশ্রেণী বিপুল সম্পদের মালিক আর আরেক শ্রেণী অর্থনৈতিক দৈন্য ও নিগ্রহের শিকার হতে হতো না।
ইসলাম সীমিত পর্যায়ে ব্যক্তিমালিকানা মেনে নিয়েছে। আল্লাহ তা’লা সংযত পর্যায়ে ধনী-গরীব উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রেখে দিয়েছেন। অন্যের বঞ্চনা ও বিড়ম্বনার কারণ না হয়ে দাড়ায়; এজন্য আল্লাহ নির্ধারিত বিধানের আওতায় মানুষকে তার অর্থনৈতিক জীবন নিয়ন্ত্রিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, “দুনিয়াতে এভাবে সীমিত পর্যায়ে জীবনযাপন করো, যেন তুমি ভিনদেশ থেকে আগত কোন মুসাফির কিংবা পথিক।”
কোন অবস্থাতেই যাতে ধনী-গরীবের এই পার্থক্য এক শ্রেণীর মানুষকে অসহায়ত্বের পর্যায়ে ঠেলে না দেয়, এক শ্রেণীর দ্বারা অন্য শ্রেণী শোষিত, নিপীড়িত ও নিগৃহীত না হয় এ ব্যাপারেও তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন। এক শ্রেণীর উন্নতি অন্য শ্রেণীর দুঃখ-দারিদ্যের কারণ হয়ে দাড়াবে, এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীকে নিজেদের আয়-উন্নতির হাতিয়ারে পরিণত করবে, এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীকে অর্থনৈতিক গোলামে পরিণত করবে, এক শ্রেণী মালিক হয়ে অন্য শ্রেণীকে তাদের সেবাদাসে পরিণত করবে, এক শ্রেণী সুখ আর ভোগেই মেতে থাকবে, আরেক শ্রেণী তাদের সুখ ভোগের জন্য দারিদ্যের যুপকাষ্ঠে বলী হবে, এক শ্রেণী পাঁচতলায় থাকবে আরেক শ্রেণী গাছতলায় থাকবে এই আকাশচুম্বী ব্যবধান ইসলাম মোটেও সমর্থন করে না। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “আমি দুনিয়ার জীবনে তাদের জীবনোপকরণকে বন্টর করে দিয়েছি এবং কতিপয়কে কতিপয়ের উপর মর্যাদাগত প্রধান্য দিয়েছি, যাতে তারা একে অন্যকে কর্মে নিয়োগ করতে পারে।” (সূরা যুখরুফ- ৩২) অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, “যাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে তারা তাদের অধিনস্থদের নিজেদের সামগ্রী থেকে কিছুই দিতে চায় না, (তারা আশঙ্কা করে) এ সম্পদে তারা উভয়েই উভয়ের সমান হয়ে যাবে; তবে কি তারা আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করছে?” (সূরা নাহল-৭১)
ইসলাম অর্থনৈতিক কাঠামোকে এমনভাবে সাজিয়েছে যে, তাতে রাতারাতি কেউ ফুলে ফেঁপে বিরাট বৈভবের মালিক হয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদের বিন্যাস এভাবে করা হয়েছে, যাতে একজন মানুষ যথারীতি পরিশ্রম করলে তার পরিশ্রমলব্ধ অর্থ দিয়ে স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দে নিজের এবং তার পরিবারের ভরণ পোষণ চলতে পারে। বিশাল বৈভবের মালিক বনে যাওয়া সহজে তার জন্য সম্ভব হবে না। এজন্য ইসলাম উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের সীমা চিহ্নিত করে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। লুটপাট, ধোঁকা, প্রতারণা ও জলুমের মাধ্যমে সম্পদ উপার্জনের সকল পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “হে মুমিনগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে একে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করো না।” অর্জিত সম্পদে বাধ্যতামুলকভাবে যাকাত, সাদাকাহ ইত্যাদি আদায়ের বিধান প্রবর্তণ করে দেওয়া হয়েছে। কার্পণ্যকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্পদ জমা করে রাখা জান্নাত প্রাপ্তির অন্তরায় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। নিজের প্রয়োজন পুরণের সাথে সাথে ব্যক্তির সম্পদে নিকটাত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজ ও দেশের মানুষের সাহায্য-সহযোগিতাকে নৈতিক কর্তব্য বলে নির্ধারণ করা হয়েছে। এভাবে ইসলাম সম্পদকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ব্যক্তি বিশেষের হাতে সঞ্চিত হওয়ার সকল পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। যদি ধনকুবেরদের জীবন ইতিহাস বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে তাদের ঐসব বিধি-বিধান অনুসরণের ক্ষেত্রে কোন এক জায়গায় ফাঁক-ফুকর রয়েছে, সেই ফাঁক দিয়েই সে বিশাল বৈভবের মালিক হয়েছে এবং অঙ্গুল ফুলে কলাগাছ থেকে বটগাছ বনে গেছে।
ইসলাম যেভাবে সম্পদের সুষম বন্টনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র যদি তা অনুসরণ করে অর্থনৈতিক কাঠামো ঠিক করতো, তবে ধনী-গরীবের মাঝে তারতম্য সৃষ্টি হতো না, ধনীরা আরো ধনী গরীবরা আরো গরীব হতে হতো না, সমাজের বেকারত্বের মাত্রা বৃদ্ধি পেতো না, কেউ পাঁচতলায় আর কেউ গাছতলায় থাকতে হতো না, প্রত্যেকের মধ্যে একটা অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিরাজ করতো।
---------------------------------------------------------------------------------------------
মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
(নিবন্ধকার, কলাম লেখক)
শিক্ষক : জামেয়া ইসলামিয়া আনওয়ারে মদিনা মাদরাসা, ইসলামপুর, সিলেট।

No comments:

Post a Comment

Pages