মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Thursday, September 20, 2018

মুহাররাম মাস ও আশুরা

মুহাররাম মাসের দশম তারিখের দিনটিকে আশুরা বলা হয়। আশুরা, আশিরুন-এর বহুবচন। এর অর্থ দশম তারিখের সমন্বয় অর্থাৎ মুহাররাম  মাসের দশ তারিখে সংঘটিত ঘটনাবলী। পৃথিবীর আদি-অন্তের ঘটনা এর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। এই দিনে কারবালা প্রান্তরে ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায় রচিত হয়েছিল। জালিম ইয়াজিদের সৈন্য কর্তৃক ফোরাত নদীর তীরে কারবালার কঙ্করময় মরু প্রান্তরে নির্মমভাবে শহীদ হন নবী করীম (স.)-এর কলিজার টুকরা ফাতেমা (রা.)-এর নয়নমণি হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) এবং তাঁর ৭৭ জন পরিজন ও ঘনিষ্ঠজন। আশুরার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সাথে শুধু কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাই জড়িত নয়; বরং ইসলামের ইতিহাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহ তা’লা এই দিনে তাঁর কুদরতের নিদর্শন প্রকাশ করেছেন। মুসলামানদের কাছে আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক।
মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
------------------------------------------------------------
কালচক্রের অবিরাম যাত্রায় ফিরে এলো হিজরি চন্দ্রবর্ষের প্রথম মাস মুহাররাম। সময়স্রোতে ভেসে যাওয়া একটি বছরের আত্মবিচার ও আগামির পরিকল্পনা গ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন বছরের যাত্রা শুরু। আত্মবিচার একজন মানুষকে ভূল-শুদ্ধ নির্ণয় করে সঠিককে গ্রহণ আর অঠিককে বর্জন করার পথ বাতলে দেয়। আর পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে কোন কাজে অগ্রসর হলে সেই কাজে গতি থাকে এবং সঠিকভাবে কাজটি সম্পাদন করা যায়। একজন সচেতন মানুষের জন্য প্রতিটি দিনই হিসাবের উপলক্ষ্য। মানুষ প্রতিদিন তার কর্মের হিসাব গ্রহণ করে এবং গতদিনের চেয়ে আগামী দিনকে অধিক ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করে। সফলতাকে আরো উচ্ছ শিখরে নিয়ে যায় এবং ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নবউদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প করে। বছরের প্রথম দিনে মানুষ বিগত এক বছরের অর্জন-বিয়োজনের হিসাব করে এবং অতীতের ভুল-ত্রুটি শুধরে নিয়ে আগামীকে আরও উজ্জল করে তোলার প্রতিজ্ঞা করে। মুসলমানদের জন্য হিজরি চন্দ্রবর্ষের দিনগুলোর হিসাব রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ইসলামের বিধি-বিধান, ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক বিভিন্ন দিবসগুলো হিজরি চন্দ্রমাসের তারিখ অনুযায়ী নির্ধারিত।

নদীর স্রোতের মতো সময়ের স্রোত বয়ে যায় অবিরত। সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর হয়েই সময়ের যাত্রা। মানুষ মায়ের গর্ভেধারণ থেকে শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ হয়ে এক সময় পরপারে পাড়ি জমানোর মধ্যদিয়ে দুনিয়ার জীবণের পরিসমাপ্তি। মালাকুল মউত মানবজীবনের নির্ধারিত সময়ে খোদার নির্দেশে প্রাণ নিয়ে যান। কেউ বলার সাধ্য নেই- কে কত দিন দুনিয়ার জীবন পাবে, কোন দিন, কোন সময়, কে কোথায় দুনিয়ার জীবনের ইতি টানবে। মানুষ স্বল্প সময়ের জীবনে ভূল-শুদ্ধ অনেক কিছুই করে। কেউ হয় সরল পথের পথিক আর কেউ হয় দুষ্ট শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণে বিপথগামী। তাই মুসলমানের কর্তব্য হল সচেতনতার ছোট-বড় যেকোনো উপলক্ষ্যকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রেরণায় নতুন মাত্রা যোগ করা। নববর্ষে মহান আল্লাহ তা’লার নিকট প্রতিটি মুসলমানের একমাত্র চাওয়া হলো তিনি যেন মুসলিম উম্মাহকে বছরজুড়ে রহমত, বরকত ও কল্যাণ দ্বারা ঢেকে দেন।

মুহাররাম মাসটি অতি সম্মানিত। এর গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের ইতিহাসে এ মাসে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা প্রসিদ্ধ রয়েছে। কুরআনের ভাষায় মুহাররাম হলো ‘আরবাআতুন হুরুম’- অর্থাৎ সম্মানিত মাস চতুষ্টয়ের অন্যতম। আল্লাহ তা’লা বলেন, “নিশ্চয় মাসসমূহের গণনা আল্লাহর কাছে, বার মাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য থেকে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজদের উপর কোন জুলুম করো না।” (সূরা তাওবা:৩৬)

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, “বছর হলো বারোটি মাসের সমষ্টি, তার মধ্যে চারটি অতি সম্মানিত। তিনটি লাগাতার জিলকদ, জিলহজ ও মুহররম আর চতুর্থটি হলো জুমাদাস সানি ও শাবানের মধ্যবর্তী রজব।” (বোখারি:২৯৫৮)

মুহাররাম মাসের দশম তারিখের দিনটিকে আশুরা বলা হয়। আশুরা, আশিরুন-এর বহুবচন। এর অর্থ দশম তারিখের সমন্বয় অর্থাৎ মুহাররাম মাসের দশ তারিখে সংঘটিত ঘটনাবলী। পৃথিবীর আদি-অন্তের ঘটনা এর সাথে স¤পৃক্ত রয়েছে। এই দিনে কারবালা প্রান্তরে ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায় রচিত হয়েছিল। জালিম ইয়াজিদের সৈন্য কর্তৃক ফোরাত নদীর তীরে কারবালার কঙ্করময় মরু প্রান্তরে নির্মমভাবে শহীদ হন নবী করীম (স.)-এর কলিজার টুকরা ফাতেমা (রা.)-এর নয়নমণি হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) এবং তাঁর ৭৭ জন পরিজন ও ঘনিষ্ঠজন। আশুরার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সাথে শুধু কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাই জড়িত নয়; বরং ইসলামের ইতিহাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহ তা’লা এই দিনে তাঁর কুদরতের নিদর্শন প্রকাশ করেছেন। মুসলামানদের কাছে আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তা’লা এই দিনে বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন।” (বুখারী ১/৪৮১)

এছাড়াও বিভিন্ন তথ্যমতে এই দিন সম্পর্কে আরো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ পাওয়া গেলেও এর  শক্তিশালী কোন ভিত্তি পাওয়া যায় না। যেমন- এই দিনে আল্লাহ তা’লা হযরত নূহ (আ.)-এর কিশতি জুদি পর্বতে স্থির করেছিলেন, আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছিলেন, পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করেছিলেন, কিয়ামত এই দিনেই হবে- অর্থাৎ যেই দিন কয়িামত সংঘটিত হবে সেই দিনটি হবে আশুরার দিন, ইত্যাদি।
মুহাররাম মাস ও আশুরার রোজা সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে রমযান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।” (বুখারী ১/২১৮)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে মুহাররাম মাসের রোজা। (মুসলিম- ১৯৮২) সুতরাং এ মাসে রোজা রাখা মহানবী (সা.) এর সুমহান আদর্শ। আশুরার রোজা স¤পর্কে হাদিসে এসেছে, হজরত রাসূলে কারীম (সা.) মদিনায় এসে দেখলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখছে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমরা তো তাদের অপেক্ষা হজরত মূসা (আ.) এর অনুসরণের অধিক যোগ্য। এরপর রাসূল (সা.) নিজেও এদিনে রোজা রাখলেন এবং উম্মতকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। (বুখারি- ১/২৫৮)

ইহুদি ও খ্রিস্টানরা এ দিবসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে রোজা রাখে। তাই রাসূল (স:) ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে মুহাররামের ১০ তারিখের রোজার সঙ্গে ৯ অথবা ১১ তারিখকে মিলিয়ে রোজা রাখতে বলেছেন। (আশুরার দিনের আগের দিন অথবা পরের দিন মিলিয়ে দু’টি রোজা) একদিন রোজা রাখা মাকরুহ।

মুহাররাম  ও আশুরার ফযিলত বর্ণনায় ইমাম বায়হাকী (রহ.) তাঁর শোআবুল ঈমান গ্রন্থে উল্লখ করেছেন, যে ব্যক্তি খালেছ মনে উদার হস্তে আশুরার দিন দান-খয়রাত করবে, আল্লাহ পাক সারা বছর তার রুজি-রোজগারে বরকত দান করেন। আশুরার রোজার ফযিলত বর্ণনায় হজরত আবু কাতাদাহ আল-আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) কে আশুরার রোজা স¤পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি ইরশাদ করেন, এ রোজার মাধ্যমে বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ হয়। (ইবনে মাজাহ, মুসলিম শরিফ)। সুতরাং এ মাসের করণীয় বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, দান-খয়রাত, তাওবা-ইস্তেগফার, নফল রোযা এবং অন্যান্য নেক আমল।

আমাদের সমাজের একশ্রেণীর লোক এই দিন সম্পর্কে কিছু ভিত্তিহীন তথ্য ও কুসংস্কার ছড়িয়ে নিজেরাও পাপাচারে লিপ্ত হন এবং সাধারন মানুষকেও বিভ্রান্ত করেন। বলাবাহুল্য যে, কারবালার নিষ্ঠুরতার ঘটনার হৃদয়বিদারক এই শোক উম্মতের হৃদয়কে ব্যথিত করে। যা মেনে নেওয়া মুসলিম উম্মাহরে জন্য সহজ নয়। তবে শাহাদাতে হুসাইন (রা.) কে কেন্দ্র করে তাজিয়া, শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র‌্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা, চাবুক মারা, অনেকে এ মাসে বিয়ে-শাদী থেকেও বিরত থাকেন, আনন্দ উৎসবসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির আয়োজন ইত্যাদি মোটেই কাম্য নয়। বরং এগুলো গর্হিত ও গোনাহের কাজ। এ ধরনের রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়া এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক চলা একান্ত জরুরী। আল্লাহ তা’লা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
----------------------------------------------------------
লেখক : নিবন্ধকার
hamidsylbd@gmail.com 

No comments:

Post a Comment

Pages