মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Saturday, December 15, 2018

প্রহসনের নির্বাচন যেন না হয়

এটা শুধু হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আশঙ্কা নয়, বরং দেশের সর্বসাধারণ আজ এই আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত ও ভীত। নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে সহিংসতার মাত্রা যে আরও প্রকট আকার ধারণ করবে তা বলাবাহুল্য। শেষ পর্যন্ত সকল দলের অংশগ্রহনে নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে পারবে কি না, মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার সুযোগ পাবে কি না, এ নিয়ে দেশের জনসাধারণ আজ উদ্বিগ্ন। বিরোধী জোটের নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের আন্দোলন ও দাবির মুখে সরকার প্রধান সব সময়ই বলে এসেছেন যে, আমাদের সরকার একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ এবং অবাধ নির্বাচন দেশের মানুষকে উপহার দিতে পারবে, সুতরাং নির্বাচনকালীন সরকারের কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্থবে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকার প্রধানের কথার কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বরং ক্ষমতার সুযোগে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সকল পন্থাই অবলম্বন করছেন ক্ষমতাসীনরা।
--------------------------------------------------------
সেলিম সামীর
--------------------------------------------------------
একাদশ সংসদ নির্বাচন অত্যাসন্ন। দীর্ঘ ১০ বছর পর সকল দলের অংশগ্রহনে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগুচ্ছে দেশ। নির্বাচনী তফশিল ঘোষনার পর ভোটাধিকার বঞ্চিত দেশের মানুষ নতুন আশায় বুক বেধেছে। দীর্ঘ দিন পর তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগের সুযোগ তৈরী হয়েছে। যদিও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন এই নির্বাচন কতটা স্বচ্ছ, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে, কিংবা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটা আদৌ প্রয়োগ করতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে জনগনের মনে রয়েছে নানা সংশয়। এই সংশয়ের যথেষ্ঠ কারনও রয়েছে। দেশের গনতান্ত্রিক রাজনীতিতে এমন পরিবেশ এখনো তৈরী হয়নি যে, ক্ষমতায় অধিষ্টিত দলীয় সরকারের অধিনে নির্বাচনের উপর মানুষ আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে পারে। দেশের বিগত স্থানীয় নির্বাচনগুলোর সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জনমনের এমন সংশয়কে আরও দৃঢ় করেছে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটসহ অন্যান্য দল দশম সংসদ নির্বাচনকে বয়কট করেছিল এ সংশয় থেকেই। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে তারা আন্দোলন করে আসছিল তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর থেকেই। এই দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে শত জেল জুলুম সয়েও শেষ পর্যন্ত তাদের দাবি পুরণ হয়নি। যে কারনে জাতীয় এক্যফ্রন্ট গঠনের পূর্ব পর্যন্ত বিএনপি জোট নির্বাচনে আসার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা ছিল। এক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর বিএনপিজোট মুলত কৌশলগত কারনেই নির্বাচনমুখী হয়। তারপর থেকেই দেশে অংশগ্রহনমুলক নির্বাচনের হাওয়া লাগে। জনমনে নাগরিক ক্ষমতা প্রয়োগের আশা জাগতে থাকে। এবারের নির্বাচনে একটি বড় অংকের নতুন ভোটারও যুক্ত হয়েছে। দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কোন অংশগ্রহনমুলক জাতীয় নির্বাচন না হওয়ায় এসব তরুন ভোটাররাও নিজের ভোট প্রয়োগের অভিজ্ঞতা লাভের জন্য মুখিয়ে আছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের চলমান সহিংস নির্বাচনী পরিস্থিতি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীসহ আপামর সাধারন মানুষের মাঝে ভয় ও শংকার সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই দেশের মানুষ নির্বাচন কেন্দ্রিক এসব সহিংসতা প্রত্যক্ষ করছে। দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের সময়েই আ.লীগের দু’গ্রুপের সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনায় দুজন নিহত হওয়া, বিএনপির পার্টি অফিসের সামনে পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ দিয়েই সহিংসতার শুরু। শুরু থেকে এ পর্যন্ত নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপেই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের প্রচারণায় বাধা দেয়া হচ্ছে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী বাধা দিতে গিয়ে আ.লীগের আরও দু’জন কর্মী নিহতের ঘটনা ঘটেছে। ঘরোয়া ও উঠান বৈঠকে ক্ষমতাসিন দলের নেতাদের উস্কানীমুলক বক্তব্য কর্মীদেরকে আরও হিংসাত্মক করে তুলছে। বিএনপির বিভিন্ন প্রার্থীদের প্রচারনায় হামলাসহ ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতাদের গাড়ি বহরে হামলা হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে হামলা আর সহিংসতা তত বাড়ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের গাড়ি বহরে হামলার পর সর্বশেষ আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ড. কামাল হোসেনের গাড়ি বহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেরার পথে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে। একই সঙ্গে জেএসডির সভাপতি আসম রবের গাড়িতে এই হামলার ঘটনা ঘটে। এর প্রতিবাদে বিকেলে ঐক্যফ্রন্টের নয়াপল্টন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনও করা হয়েছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় সহিংসতার স্বরুপ আরও বড় হয়ে সামনে এসেছে। এতসব ঘটনা কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশের সামনেই ঘটেছে, কিন্তু পুলিশ নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছে। পক্ষান্তরে বিএনপি নেতাকর্মীদের উপর পুলিশের মামলা হামলা, ধর পাকড় অব্যাহত রয়েছে। পুলিশি পাকড়াও অভিযান আগের চেয়ে বরং এখন আরো বেড়ে গেছে। আমার জেলা সিলেটের ১নং আসনের ধানের শীষ প্রার্থীর প্রচারনা থেকে আজকেও অনেক সাধারণ কর্মীকে পুলিশ ধরে নেয়ার খবর পেয়েছি। একদম নগন্য কর্মী ও সমর্থকরাও ধর-পাকড় থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। সমর্থকরা প্রার্থীর সাথে প্রচারণায় নামলেই চলছে পুলিশের ধর-পাকড়। সারা দেশেই এমন পরিস্থিতি বিদ্যমান। একদিকে সরকারদলীয় লোকদের হামলা, অন্যদিকে পুলিশের ধর-পাকড়ের ভয়ে তারা প্রচারনায় নামতেই পারছেন না।
সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হল, এসব ঘটনায় সিইসির আচরন পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ। এসব সহিংস ঘটনায় সিইসি নিন্দা আর বিব্রত হওয়ার অনুভুতি জানিয়েই যেন দায় সারছেন। এসব ঘটনার ব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্ত করে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। তিনি নির্বাচনকেন্দ্রীক সহিংসতা আরও বৃদ্ধির শংকা প্রকাশ করেছেন, অথচ, এ ধরনের ঘটনা আর যেন না ঘটে সে ব্যাপারে ইসির কোন পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচন উপলক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক সমন্বয় সভায় সিইসি বললেন, ‘কেউ যেন ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারীর মত তান্ডব চালাতে না পারে।’ এজন্য তিনি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সিইসি প্রধানের এমন মন্তব্য এবং নির্দেশ নিঃসন্দেহে অনভিপ্রেত ও পক্ষপাতমুলক। সিইসির এমন প্রশ্নবিদ্ধ আচরন অবাধ এবং অংশগ্রহনমুলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথকে যে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ করছে এবং করবে এমন ধারনা করা মোটেই অমুলক নয়।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের একটি প্রতিবেদনে দাবি করেছে যে, নির্বাচনী প্রচারণার মধ্যে বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের ওপর ধরপাকড়, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং নজরদারি চলছে। সংস্থাটির মতে, নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনকে ঘিরে পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে এবং এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলার মতো যথেষ্ট পস্তুতি প্রতিষ্ঠানটির নেই। এজন্য বিভিন্ন দেশ ও বিদেশি সংস্থার পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন বলে মনে করেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি। বিবিসিকে তিনি বলেন, "সরকার যখন নির্বাচন করে তখন তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেমন: নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হয়।" কিন্তু নির্বাচন কমিশনসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পক্ষপাতমূলক বলে তিনি উল্যেখ করেন। মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, "নির্বাচন কমিশন একটি দলের লোকজনের মনোনয়ন বাতিল করছে, অন্য দলেরটা করছে না। শুধু এক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশে একটা অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ আমরা দেখছি না।" এই পরিবেশে বিদেশি পর্যবেক্ষক না থাকলে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এটা শুধু হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আশঙ্কা নয়, বরং দেশের সর্বসাধারণ আজ এই আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত ও ভীত। নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে সহিংসতার মাত্রা যে আরও প্রকট আকার ধারণ করবে তা বলাবাহুল্য। শেষ পর্যন্ত সকল দলের অংশগ্রহনে নির্বাচন অনুষ্ঠান হতে পারবে কি না, মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার সুযোগ পাবে কি না, এ নিয়ে দেশের জনসাধারণ আজ উদ্বিগ্ন। বিরোধী জোটের নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের আন্দোলন ও দাবির মুখে সরকার প্রধান সব সময়ই বলে এসেছেন যে, আমাদের সরকার একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ এবং অবাধ নির্বাচন দেশের মানুষকে উপহার দিতে পারবে, সুতরাং নির্বাচনকালীন সরকারের কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্থবে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকার প্রধানের কথার কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বরং ক্ষমতার সুযোগে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সকল পন্থাই অবলম্বন করছেন ক্ষমতাসীনরা।
ক্ষমতা ঠিকিয়ে রাখার পথ সুগম করতে ক্ষমতাসীনরা যদি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে এভাবেই প্রভাবিত করেন, এটা ক্ষমতাসীনদের জন্য হীতে বিপরীতই হবে। তারা হয়ত ক্ষমতার মসনদটা তাদের দখলেই রেখে দিতে পারবেন, কিন্তু জনসমর্থন পুরোপুরি হারাবেন। আমরা আশা করব আ.লীগ প্রধান এমন আত্মঘাতি পথ থেকে দলের নেতাদেরকে ফেরাবেন, দলকে বাচাবেন। এ নির্বাচন যেন প্রহসনের নির্বাচন না হয়। জাতিকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিন। তাতে করে হয়তবা আপনারা বিজয়ী হবেন, কিংবা ক্ষমতার পালাবদল ঘটবে, কিন্তু পরিশেষে আপনার দলই উপকৃত হবে।

লেখক: কলাম লেখক ও ব্লগার
০১৭১৫ ৯২৯২৭০

No comments:

Post a Comment

Pages