মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Wednesday, March 27, 2019

হিংসা থেকে জঙ্গি হামলা

----------------------------
মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
-----------------------------
১৫ ই মার্চ জুম’আ বার। স্থানীয় সময় তখন দুপুর ১ টা ৪৫ মিনিট। জুম’আর নামাজ চলছিলো মসজিদগুলোতে। ঠিক তখনই হাতে অত্যাধুনিক অগ্নেয়াস্ত্র, মাথায় হেলমেটে সেট করা ক্যামেরা নিয়ে এক শ্বেতাঙ্গ যুবক মসজিদের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। মসজিদের মূল ফটকের কাছে গিয়েই শুরু করলো ব্রাশফায়ার। মুসল্লিদেরকে টার্গেট করে ট্রিগার চাপতে লাগলো। ট্যা..ট্যা শব্দ আর ঝলসাচ্ছে আগুনের স্ফুলিঙ্গ। হতভম্ব হয়ে মুসল্লিরা চিৎকার চেচামেচি, এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতে লাগলেন। কেউবা বুলেটের আঘাতে ঝাজড়া হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। মুহুর্তেই মুসল্লিদের রক্তে লাল হয়ে গেল গোটা মসজিদ। সন্ত্রাসী যুবকটি ঠান্ডা মাথায় মসজিদের এক দিক থেকে আরেক দিকে ঘুরে ভেড়াচ্ছে আর ট্রিগার চেপে চেপে লুটিয়ে পড়া মুসল্লিদের মৃত্যু নিশ্চিত করছে। আর তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভ সম্প্রচার করে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিচ্ছে। এই ঘৃণ্য ও নৃশংস ঘটনা ঘটেছে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটো মসজিদে। প্রথমে ডিন এভিনিউয়ে অবস্থিত আল-নূর মসজিদে এবং এর কয়েক মিনিট পর একই কায়দায় লিনউড মসজিদে।
আল-নূর মসজিদে ৪২ জন এবং লিনউড মসজিদে ৭ জন মুসল্লি শাহাদাত বরণ করলেন। এর মধ্যে রয়েছেন ৫ জন বাংলাদেশী। আহত হয়েছেন আরো অর্ধশতাধিক। নিখুঁজ রয়েছেন আরো অনেক। শাহাদাত রবণকারীদের ৫ জনের একজন সিলেটের হুসনে আরা পারভীন। তিনি তার স্বামীকে বাঁচাতে এসে নিজেই সন্ত্রাসীর বুলেটের আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন। আরেক জন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. সামাদ। অন্যদের তথ্য এ পর্যন্ত জানা যায়নি। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা।

ঘটনাটি ঘটিয়েছে ব্রেনটন ট্যারেন্ট নামক অস্ট্রেলীয় এক শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান জঙ্গি। সে টুইটারে প্রায় ৮০ পাতার একটি ইশতেহার আপলোড করেছে। এতে উল্লেখ করেছে- ‘আমি মুসলিমদের অপছন্দ করি। আমি সেসব মুসলিমকে ঘৃণা করি, যারা অন্য ধর্ম থেকে এসে মুসলিম হয়’। হামলাকারী এসব মুসলিমকে রক্তের সঙ্গে প্রতারণাকারী উল্লেখ করে বলেছে- ‘এসব প্রতারণাকারীর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই’।


ইশতেহারে সে এও বলেছে- ‘এটি একটি সন্ত্রাসী হামলা’। হামলার মাধ্যমে সে অনুপ্রবেশকারীদের (অভিবাসীদের) দেখাতে চায় যে, ‘আমাদের ভ‚মি কখনও তাদের ভ‚মি হবে না, যতক্ষণ শেতাঙ্গরা জীবিত থাকবে’। নিজেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤েপর একজন সমর্থক হিসেবে তুলে ধরে হামলাকারী বলেছে- ‘পুনরুজ্জীবিত শ্বেতাঙ্গ পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে আমি অবশ্যই ট্রা¤েপর একজন সমর্থক’। হামলাকারী জঙ্গি আরো বলেছে, ‘আমি ডিলান রুফসহ আরও অনেকের বই পড়েছি। তবে আমি প্রকৃতভাবে অ্যান্ডারস ব্রেইভিকের ওই হামলা থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছি’। ২০১১ সালে নরওয়েতে অ্যান্ডারস ব্রেইভিক বোমা ও গুলি চালিয়ে ৭৭ জনকে হত্যা করেছিল। সা¤প্রতিক সময়ে মুসলিম বিদ্বেষ ও বর্ণবাদী রাজনীতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে হেইটক্রাইম বেড়ে গেছে। পশ্চিমা বর্ণবাদী ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রোপাগান্ডায় একশ্রেনীর বিভ্রান্ত উগ্রপন্থী মানুষ প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলায় লিপ্ত হচ্ছে।
নিউজিল্যান্ডের ২০১৩ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশটিতে প্রায় ৪৬ হাজার মুসলমান বসবাস করেন, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ। সরকারের তথ্য অনুযায়ী ওই ৪৬ হাজার মুসলমানের মধ্যে ২৮ শতাংশ এসেছেন ২০০৬ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে। আর এক চতুর্থাংশ জন্মগ্রহণ করেছেন নিউজিল্যান্ডে। নিউজিল্যান্ডে বসবাস করা অধিকাংশই ইসলামের শাস্যত নীতিতে বিমোহিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এবং এই সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হামলাকারী জঙ্গি তা সহ্য করতে পারেনি। মুসলমানদের প্রতি হিংসা ও ঘৃণার কারণে সে এই হামলা চালিয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা গেছে, হামলাকারী জঙ্গি আগেই টুইটারে হামলার ইশতেহার আপলোড করে ছিল। এমনকি সে তার রাইফ্যালের ছবিও আপলোড করেছিল। এবং সফলভাবে তার কার্যসম্পন্ন করে শান্তির দেশে অশান্তির আগুন জালিয়ে দিলো। এই ঘটনার মাধ্যমে এক বিষাক্ত আপরাধের স্বাদ পেল নিউজিল্যান্ড। স্বয়ং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী একে দেশের অন্ধকারতম দিনগুলির মধ্যে একটি বলে বিবৃতি দিয়েছেন।
হামলাকারীর দেয়া ইশতেহার ও আক্রমণের ধরণ দেখে সহজেই অনুমেয় হয় যে, এই হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত এবং সংঘবদ্ধ। এই ঘটনা কীভাবে ঘটল কেবল তা চিহ্নিত করাই এখন যথেষ্ট নয়। আরো অনেক কিছুই চিহ্নিত করতে হবে। এই জঙ্গি হামলার দায়ী ব্যক্তিরা কীভাবে নজরদারীর আওতার বাহিরে থাকল, দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কী করল, এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে। হামলার আগেই টুইটারে হামলার ইশতেহার আপলোড করার পরেও নিউজিল্যাডের পুলিশ, গোয়েন্দা তথা নিরাপত্ত¡া বাহিনীর কেউ কিছুই করতে পারলো না। এটা সত্যিই দুঃখজনক। এটা তাদের বড় ধরণের একটা ব্যর্থতা। ভাবতে অবাক লাগে, শান্তির দেশ হিসেবে খ্যাত উন্নত রাষ্ট্রের দাবিদার নিউজিল্যান্ডের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতো দুর্বল কেন? পুর্বাভাস দেয়ার পরেও সেদেশের নিরাপত্তাবাহিনীর নাকের ডগায় নিরাপদে মসজিদে ঢুকে অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে ১৭ মিনিটব্যাপী নির্বিচারে মুসল্লিদের উপর গুলি করলো এবং মসজিদে রক্তের বন্যা বয়ে গেল, অথচ নিরাপত্তাবাহিনী কিছুই করতে পারলো না। নাকি এরা মুসলমান বলেই এদের নিরাপত্তার কোন প্রয়োজন ছিল না।
এই সাদা সন্ত্রাসীর ব্রাশফায়ারে মানুষ হত্যার নিন্দা ও নিহতদের প্রতি শোক, ক্ষোভ জানিয়েছেন বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষ। কিন্তু শান্তির বাণী উচ্ছারণকারী অশান্তির কারিগর পশ্চিমারা মুখে নিন্দা ও শোক প্রকাশ করলেও কার্যত কোন প্রদক্ষেপ নিবে কী না, তা তাদের শোক বার্তা থেকেই অনুমান করা যাচ্ছে।
সমগ্রবিশ্বে অশান্তি সৃষ্টির কারিগর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘এটি খুবই ভয়াবহ একটা ঘটনা, কিন্তু এ দিয়ে শ্বেত জাতিয়তাবাদ বিস্তৃত হচ্ছে, সে কথার প্রমাণ হয় না’। তিনি বলেন, ‘নিউজিল্যান্ডে যা ঘটেছে তা গুটিকয় মানুষের হাতে খুবই ভয়াবহ একটি ঘটনা’।
তার মন্তব্যে তিনি এই হামলার শিকার যে মুসলমানরা তা উল্লেখ করেননি। এটি একটি ‘জঙ্গি হামলা’ বা ‘সন্ত্রাসী হামলা’ এধরণের কোন শব্দ উচ্ছারণ করেননি। কারণ, হামলাকারী কোন মুসলমান নয়। যদি তাদেরই প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে কোন মুসলমান কর্তৃক এরকম হামলার ঘটনা ঘটত, তাহলে মুহুর্তেই বিশ্ব সকুনের দল ও তাদের মিডিয়া এটাকে ‘জঙ্গি’ সন্ত্রাসী হামলা বলে চিৎকার শুরু করে দিতো। মসজিদে হামলাকারী ব্রেনটন ট্যারেন্ট শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান হওয়ায় তাকে জঙ্গি বলতে তাদের মুখে ঠাডা পড়েছে। তারা বরাবরই এসব হামলার দায় ঢালাওভাবে মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়। অথচ, গ্লোবাল টেররিজম ডাটাবেইসের হিসাব এফবিআই ডাটাবেইস থেকে বের হওয়া এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ১৯৮০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ঘটা মাত্র ৬ শতাংশ সন্ত্রাসী হামলায় মুসলিম সন্ত্রাসীরা জড়িত ছিল। মুসলমানরা বিশ্বের জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ হলেও সন্ত্রাসী হামলায় তাদের অনুপাত ১৯৭০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০.৩ শতাংশ। এসব তথ্য জানান দিচ্ছে, বিশ্বের বেশীর ভাগ সন্ত্রাসী হামলা ঘটেছে অমুসলিম জঙ্গিদের দ্বারা।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম অন্যায়ভাবে কাউকে আক্রমণ করার শিক্ষা দেয় না। ইসলাম আক্রমণ প্রতিহত করার শিক্ষা দেয়। ইসলামের নবী সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অশান্তির সমাজকে শান্তির সমাজে রূপান্তরিত করেছিলেন। সুতরাং কোন প্রকৃত মুসলমান বিশ্বের কোথায়ও কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত হতে পারে না। যখনই ইসলাম এবং মুসলমানদের উপর আঘাত এসেছে তখনই মুসলমানরা তা প্রতিহত করেছেন। এই নীতি এখনও আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। আত্মরক্ষার লড়াই কখনো সন্ত্রাস হতে পারে না। কোন মুসলমান কর্তৃক অন্যায়ভাকে হামলার যেসব তথ্য পাওয়া যায়, এগুলোর পেছনেও রয়েছে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্ধেষীদের চক্রান্ত। মুসলিম যুবকদের বিভ্রান্ত করে নানা ধরনের জঙ্গিবাদী সংগঠন গড়ে তুলে আত্মঘাতি হামলা ও জঙ্গিবাদী প্রচারণায় মদদ দেয়ার পেছনেও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমপৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে দলে দলে মানুষের ইসলাম গ্রহন এবং মুসলমানদের জাগরণ ইসলাম বিদ্ধেষী শক্তিগুলো বরদাশত করতে পারে না। তারা এই বিদ্ধেষের কারণে সদা-সর্বদা মুসলমানদের অনিষ্ঠ সাধনে লেগে থাকে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটো মসজিদে মুসলিম বিদ্ধেষের চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটিযেছে শ্রেষ্ঠবাদী সাদা জঙ্গি অষ্ট্রেলীয় নাগরিক ব্রেনটন ট্যারেন্ট। সে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤েপর উগ্র সমর্থক ক্যানডিস ওউনসের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই হামলা চালিয়েছে। নামাজরত শহীদ মুসল্লিদের রক্তের বন্যায় ভেসে জাক মুসলিম বিদ্ধেষীরা। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের জাগরণ ঘটুক। বিশ্ব মুসলিমদের আর নিরব বসে থাকার সময় নেই। জাগতে হবে এখনই। রুখে দাড়াতে হবে ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুদের বিরুদ্ধে। ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের শত্রুদের মোকাবেলা করতে হবে।

-------------------------------------------------------------
মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
নিবন্ধকার ও কলাম লেখক
শিক্ষক : জামেয়া আনওয়ারে মদিনা, পশ্চিম ভাটপাড়া, ইসলামপুর, সিলেট।
Email : hamidsylbd@gmail.com

No comments:

Post a Comment

Pages