মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Friday, February 1, 2019

যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে ইসলামী অনুশাসন

ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত 

নীতিবোধ ও মুল্যবোধ শিক্ষায় যদি ধর্মীয় অনুশাসনের সংশ্লিষ্টতা না থাকে, আইন প্রনয়ণের ক্ষেত্রে যদি ধর্মীয় মুল্যবোধের প্রয়োগ না হয়, তবে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার দিকে দ্রুততম এগিয়ে চলা এ সমাজের চারিত্রিক অধঃপতন ঠেকানো আইনের পক্ষে অসম্ভব হবে। গ্লোবাল ভিলেজের এই যুগে আধুনিকতার সাথে যদি ধর্মীয় অনুশাষনের সমন্বয় করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ইউরোপের মত এ সমাজ যে অবাধ যৌনতার পথে পা বাড়াবে না, তার কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। আমাদের দেশের কিছু কিছু পার্ক ও বেসরকারী কলেজ ভার্সিটির শিক্ষার্থিদের অবাধ মেলামেশার পরিবেশ এমন আশংকাকেই বরং সত্য প্রমান করে।
--------সেলিম সামীর--------

ইভটিজিং বা যৌন উত্যক্তের ব্যাপারটি আমাদের দেশে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ইভটিজিংয়ের কারণে অজস্র স্কুল ছাত্রীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই উৎপীড়নের যন্ত্রনা থেকে পরিত্রান পেতে স্কুল ছাত্রী ও পেশাজিবি মেয়েদের সুইসাইডের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। ধুলিস্মাৎ হয়ে যাচ্ছে একেকটি পরিবারের স্বপ্নসৌধ। শিক্ষার্থী, পেশাজীবি, কর্মজীবি নির্বিশেষে সব নারীদের ক্ষেত্রেই এমন উত্যক্ত ও উৎপীড়নের ঘটনা ঘটছে। এই উত্যক্তের ব্যাপারটি অনেক ক্ষেত্রে শারিরিকভাবে ‘যৌন হেনস্তা’ এমনকি ‘ধর্ষন’ পর্যন্ত গড়াচ্ছে। ‘যৌন উত্যক্ত’, ‘যৌন হেনস্তা’, আর ‘ধর্ষন’ এই তিনটি ক্রিয়ার ধরন ভিন্ন হলেও সবগুলোর প্রকৃতি একই; তা হল ‘যৌনতা’। ‘ইভটিজিং’ হচ্ছে বিকৃত যৌনতার দিকে ধাবিত করার প্রাথমিক এলিমেন্ট। এই ‘ইভটিজিং’ তথা যৌন উত্যক্তের মানষিকতাই একসময় ‘যৌন হেনস্তা’ আর ‘ধর্ষন’ এর মত পৈশাচিক কর্মকান্ডের দিকে ধাবিত করে। তবে এই উত্যক্ত কিংবা যৌন হেনস্তার মত মানষিক ব্যাধিতে শুধু যে আমাদের সমাজই আক্রান্ত তা নয়, বহিঃবিশ্বও এই ব্যাধির শিকার। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পাওয়া হ্যাশট্যাগ ‘মি টু’ আন্দোলন এই যৌন হেনস্তা ও নিপীড়নকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছে। বর্তমানে ভারতে ‘মি টু’ আন্দোলন খুবই সরগরম। ‘মি টু’র মাধ্যমে ভারতের অনেক তারকা মুখ খুলেছেন। এ আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের সমাজের শিক্ষিত ও উঁচু শ্রেণীর ভিতরে যৌন হেনস্তার ভয়ংকর চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। তবে অতি আধুনিকতা ও অতি প্রগতিশীলতার মাঝে গা ভাসানো সমাজের এমন চিত্র দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
পক্ষান্তরে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সমাজের এমন নৈতিক ও চারিত্রিক অধঃপতন কোনভাবেই কাম্য নয়। ৯২ শতাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশের হিন্দু বৌদ্ধ সহ অন্যান্য সকল ধর্মের মানুষই ধর্মপরায়ন। ধর্মীয় মুল্যবোধে বিশ্বাসী রক্ষনশীল পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থার এই দেশে এমন নৈতিক অধঃপতন সত্যিই দুঃখজনক। এই ইভটিজিং প্রতিরোধে সরকার শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নিয়েছে। আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু আইনের সুফল কি পেলাম আমরা? যৌনতা সংশ্লিষ্ট অপরাধ উত্তরোত্তর আশংকাজনক হারে বাড়ছে। ইভটিজিং বন্ধ হোক, মেয়েরা স্বাধীনভাবে এবং নিরাপদে চলাফেরা করার মতো পরিবেশ ও সমাজ সৃষ্টি হোক, এটা সবারই কাম্য। কিন্তু শুধুমাত্র আইনের শাস্তি দিয়ে কি এসব চরিত্র সংশ্লিষ্ট অপরাধ রোধ করা যায়? সকল অপরাধ দমনেই দেশে আইন প্রচলিত আছে। ধর্ষনের বিচারেও আইন আছে, কিন্তু ধর্ষন কী বন্ধ হয়েছে? বরং এই ‘ধর্ষন’ বর্তমান অপরাধ প্রবনতার দিক থেকে শীর্ষস্থানেই আছে। সুতরাং অপরাধ প্রতিরোধে শুধুমাত্র বিচারিক আইনের উপর নির্ভর করে থাকার কোন সুযোগ নেই। আইন বিশেষজ্ঞ এবং আইন প্রনয়ণকারি কর্তৃপক্ষের এ বিষয়টা একটু গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত যে, ইভটিজিং তথা যৌন উত্যক্ত, যৌন উৎপীড়নের প্রবণতা যুব সমাজের মধ্যে আসছে কোত্থেকে, কিভাবে তৈরী হচ্ছে যৌন হেনস্তা, নিপীড়ন ও ধর্ষনের মত পাশবিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার মত বিকৃত মন-মানষিকতা। এসবের পেছনে যে অদৃশ্য বিষয়গুলী ভূমিকা রাখছে, সেগুলোর ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে সমাজ ব্যবস্থায় প্রয়োগ করতে পারলে সমাজের এমন অধঃপতন রোধ করা যেতে পারে।
আইন দর্শন হচ্ছে মানবীয় বিবেক-বুদ্ধি প্রসূত একটি বিষয়। যখন আইনসংশ্লিষ্ট নতুন কোন বিষয় বা সমস্যা মানুষের সামনে আসে, নতুন কোন অপরাধ প্রবনতা সৃষ্টি হয়; তখন এসবের সমাধানে বা প্রতিরোধে যে সিদ্ধান্তকে মানুষ নিজের জন্য বা সমাজের জন্য কল্যাণকর বলে মনে করে তাকেই আইন হিসেবে প্রণয়ন করে। তবে একটা বিষয় আমরা ভাল করেই জানি যে, বিচারিক আইনের প্রয়োগ হয় অপরাধ সংঘটিত হবার পর, আগে নয়। অপরাধ সংঘটন রোধ করতে আইন অক্ষম। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ইসলাম শুধু অপরাধের শাস্তির বিধানই দেয়নি, বরং মানুষ থেকে অপরাধ যাতে সংঘটিত না হয় সে জন্য মানুষের সার্বিক জীবনকে একটি সুশৃঙ্খল গন্ডির মধ্যে বেধে দিয়েছে। চারাগাছকে যেভাবে খুটির সাথে বেধে দেয়া হয় যাতে কোন দিকে হেলে না পড়ে এবং ঝড়ে উপড়ে না যায়, তেমনি ভাবে ইসলাম একটি মানব সন্তানকে নীতিবোধ আর মুল্যবোধের এমন এক শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলে যাতে সে কখনো স্রষ্টা নির্দেশিত জীবনের সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে না যায়, অনৈতিকতার অদৃশ্য ঝড়ে উড়ে না যায়। মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে ইসলাম দেয় প্রকৃতি এবং বাস্থবতার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ গাইডেন্স বা দিক নির্দেশনা।
ইভটিজিং কিংবা যৌন নিপীড়ন মূলতঃ নীতিবোধ এবং মুল্যবোধ সংশ্লিষ্ট একটি ব্যাপার। আর নীতিবোধ ও মুল্যবোধ মুলতঃ আমরা ধর্ম থেকেই শিক্ষা পাই। কারণ, মানবীয় বিবেক-বুদ্ধি যদি ঐশী জ্ঞানের বন্ধনমুক্ত হয় তাহলে তা মানবীয় প্রবৃত্তির গোলাম হয়ে পড়ে। সেখানে তখন নীতিবোধ বা মুল্যবোধের কোন শক্তিশালী ভিত থাকে না। তেমনি থাকে না নীতিবোধের নির্দিষ্ট কোন মানদন্ড। আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মীয় জ্ঞান থেকে মুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ বিবেক বা জ্ঞানকে বলা হয় ‘মুক্তবুদ্ধি’। সিদ্ধান্তের ভার যখন এই মুক্তবুদ্ধির ওপর ছেড়ে দেয়া হয়, মুলতঃ তখন মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মুক্ত তার প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা এবং স্বার্থের শিকার হয়ে পড়ে। এ কারণে কুরআনে কারীমের পরিভাষায় এমন ‘আকল’ বা জ্ঞানকে ‘হাওয়া’ বা প্রবৃত্তি বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছেঃ “সত্য যদি সে সব লোকদের প্রবৃত্তির অনুগত হয়ে যেত, তাহলে আকাশ জমিন এবং সৃষ্টিকুলের মাঝে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হত।” অন্য আয়াতে পৃথিবীর সমস্থ বিপর্যয়ের জন্য মানুষকেই দায়ী করে বলা হয়েছে-“জল ও স্থলের মধ্যে যত বিপর্যয়, তা মানুষের নিজ হাতের-ই কর্মফল।”(সূরাহ রোম-৪১)
সুতরাং নীতিবোধ ও মুল্যবোধ শিক্ষায় যদি ধর্মীয় অনুশাষনের সংশ্লিষ্টতা না থাকে, আইন প্রনয়ণের ক্ষেত্রে যদি ধর্মীয় মুল্যবোধের প্রয়োগ না হয়, তবে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার দিকে দ্রুততম এগিয়ে চলা এ সমাজের চারিত্রিক অধঃপতন ঠেকানো আইনের পক্ষে অসম্ভব হবে। গ্লোবাল ভিলেজের এই যুগে আধুনিকতার সাথে যদি ধর্মীয় অনুশাষনের সমন্বয় করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ইউরোপের মত এ সমাজ যে অবাধ যৌনতার পথে পা বাড়াবে না, তার কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। আমাদের দেশের কিছু কিছু পার্ক ও বেসরকারী কলেজ ভার্সিটির শিক্ষার্থিদের অবাধ মেলামেশার পরিবেশ এমন আশংকাকেই বরং সত্য প্রমান করে। একটা বিষয় যদি আমরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব, যে শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় জ্ঞানের বন্ধন থাকে, সে শিক্ষায় শিক্ষিতদের চরিত্রে অপরাধ প্রবণতা খুবই কম। উদাহরণতঃ আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যারা গড়ে উঠে, তাদের জীবনধারার দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব, ইভটিজিং তো নয়ই অন্যান্য যে কোন ধরণের অপরাধ প্রবণতাও তাদের মধ্যে প্রায় নেই বললেই চলে। আমরা যে কোন পুলিশ ষ্টেশনে খোঁজ নিলে মাদ্রাসা শিক্ষিত তথা ইসলামী ভাবধারায় গড়ে উঠা জনগোষ্ঠীর নামে অপরাধ সংশ্লিষ্ট মামলা হাজারে একটাও হয়তো পাওয়া যাবে না। এর মূলে রয়েছে ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাব।
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় নারী পুরুষের চলাফেরা, শিক্ষা ও কর্মস্থলের জন্য এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ বিধান রাখা হয়েছে যা অতি জীবন্ত এবং বাস্থবিক। ইভটিজিং ও যৌন নিপীড়ন বন্ধে পর্দা ব্যবস্থা তথা চরিত্র সংশ্লিষ্ট ইসলামী অনুশাসন অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। এই অনুশাষন যেমন দৈহিক, তেমনি মানষিক ও আধ্যাতিœক। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় নারী পুরুষের চলাফেরা, পোষাক-পরিচ্ছদ, পরস্পর মোয়ামালাত-মোয়াশারাতের ব্যাপারে যে গাইডেন্স দেয়া হয়েছে তা অত্যন্ত সার্বজনীন, কল্যাণকর এবং প্রাকৃতিক। নারী পুরুষের মধ্যে যে পাপ কাজ সংঘটিত হয় তার মূলে রয়েছে চোঁখের দৃষ্টি। মুলতঃ চোঁখের দর্শনেই অন্তরে পাপের বাসনা জেগে উঠে। চোঁখের অসংযত দৃষ্টি-ই মানুষকে পাপের সাগরে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এ জন্যই পবিত্র কোরআনে দৃষ্টির হেফাজতের জন্য কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারন করে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-“হে  নবী! মুমীন পুরুষদেরকে বলুন, তারা যেন দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাজত করে। এতে তাদের জন্য উত্তম পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। এবং ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে।” ইমাম আবু হানিফা রহঃ বলেছেনঃ নর-নারীর একে অন্যের প্রতি হঠাৎ দৃষ্টি পড়ার পর পুনঃদৃষ্টি করা জায়েয নয়। রাসূলে করীম সঃ বলেছেনঃ অনিচ্ছাকৃত এক নজরের পর ইচ্ছাকৃত দ্বিতীয় নজর করো না। তোমার প্রথমটি ক্ষমার যোগ্য হতে পারে, কিন্তুু দ্বিতীয়টি ক্ষমার যোগ্য নয়।
ইসলাম নর-নারীর ড্রেসকোডের ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ বিধান দিয়েছে। নর-নারীর দেহাবরণের নির্দিষ্ট সীমারেখা পরিস্কারভাবে বর্ণনা করেছে। তেমনি ভাবে শালীন ও ভদ্র পোষাকের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে নারীদের বেলায় জাকজমকপূর্ণ, অশ্লীল এবং বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ করার মতো আবেদনময়ী পোষাক পরিধানে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মহান আল্লাহ নারী-পুরুষের দেহের আকর্ষণীয় স্থানগুলোকে আড়াল করার জন্যই পোষাকের প্রবর্তন করেছেন। কোরআনের বাণী-“হে বনী আদম! আমি তোমাদের জন্য পোষাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি দেহাবরণ বস্ত্র। আর পরহেযগারীর পোষাকই হচ্ছে সর্বোত্তম।” (সূরাহ আরাফ, আয়াতঃ ২৬) ইসলাম পুরুষের চেয়ে নারীর পোষাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে বেশি কঠোরতা অবলম্বন করেছে। এটা নারীদের প্রতি কোন অবিচার বা বিদ্বেষমুলক নয় বরং তা তাদের ইজ্জত, আব্রæ ও সম্ভ্রমের সুরক্ষার জন্যই। এ বিধান নারীদের স্বাধীনতাকে গন্ডিবদ্ধ করার জন্য নয়, বরং মর্যাদাহানী, শ্লীলতাহানী, লোকচক্ষুর প্রদর্শনী হওয়া এবং পণ্য হিসেবে ব্যবহার হওয়া থেকে রক্ষার জন্য। কারণ, নারীদের অসংযত পোষাক, আবেদনময়ী চলনভঙ্গি এবং অশালীন দেহ প্রদর্শনীই যুব সমাজকে অন্যায় আচরণে উস্কে দেয়। প্রগতিবাদী, নারীবাদী বুদ্ধিজীবিরা মানতে না চাইলেও বাস্থবতা এটাই যে, জীব জগতের প্রতিটি নারী জাতিই দৈহিক গঠন শৈলির দিক থেকে আত্মরক্ষাত্মক এবং পুরুষ জাতি আক্রমনাত্মক। আধুনিক বিজ্ঞানের কথাও এটাই। বর্তমান যুগে নারীরা পুরুষের কাধে কাধ মিলিয়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে গেলেও নিজেদের মান-মর্যাদা রক্ষার বেলায় যে তারা অত্যন্ত দুর্বল তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এ জন্য কোন উদাহরণের প্রয়োজন নেই। মুলতঃ ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় পর্দার বিধান হচ্ছে নারীদের এরকম অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এবং দুর্ঘটনা থেকে রক্ষার এক অতন্দ্র প্রহরীর মতো। নারীদের পর্দা এবং তাদের চাল-চলন ও পোষাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে নীতিমালা বর্ণনা করে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- “আর মুমীন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাজত করে। তারা যেন যা এমনিতেই প্রকাশমান এমন সৌন্দর্য ছাড়া তাদের কোন রকম সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন তাদের ওড়নাকে বক্ষদেশে দিয়ে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজ ছেলে, স্বামীর ছেলে, আপন ভাই, আপন ভ্রাতুস্পুত্র, আপন ভাগ্নে, মুসলিম মহিলা, কৃতদাস ও দাসী, কামভাবমুক্ত অশীতিপর বৃদ্ধ ও এমন নাবালক যারা এখনো নারীদের গোপনীয়তা সম্পর্কে বোঝে না- শুধু এদের ছাড়া আর কারো নিকট সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। (সূরাহ নূরঃ ৩১) অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে-“হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মুসলিম নারীদের জানিয়ে দিন, তারা যেন তাদের শরীরের উপর চাঁদর ঢেকে দেয়, তাতে সহজেই তাদের চিনতে পারা যাবে (সম্ভ্রান্ত মহিলা বলে) এবং তাদের আর নির্যাতিতা হতে হবে না; তারা বেইজ্জতি হতে রক্ষা পাবে।” (সূরাহ আহযাব-৫৯) উল্লেখিত আয়াতসমুহে নারী জাতির নিরাপত্তা মূলক ব্যবস্থা হিসেবেই যে আল্লাহ তায়ালা এমন বিধান দিয়েছেন তা সহজেই অনুমেয়।
কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, বেপর্দা, সহশিক্ষা, উগ্র আধুনিকতা, দেহ প্রদর্শনী, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইত্যাদি পশ্চিমা সংস্কৃতিকে আমরা অগ্রগতি ও প্রগতির সোপান মনে করি আর ইসলামী শিক্ষাকে মনে করি মৌলবাদী শিক্ষা, অনগ্রসরতা এবং প্রগতির পথের অন্তরায়। আল্লামা ইকবাল কয়েকটি কথায় প্রগতিবাদের বাস্থবতাকে তুলে ধরেছেন-
নগ্ন ঊরু প্রদর্শনীর যাদুতে বাড়েনি অগ্রগতি,
দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে আসেনি উন্নতি।
ধর্মহীনতায় পায়নি তারা সাফল্য,
ইংরেজী অক্ষরেও নেই কোন যাদু মন্ত্র।
পশ্চিমা উন্নতি এসেছে কেবল তাদের জ্ঞান-বিদ্যায়,
আজ তারা মহা ধনী মোদের ছেড়ে দেয়া পেশায়।
শার্ট-প্যান্ট-টাই পরার নাম নয় প্রগতি,
দাড়ি-টুপি-পাগড়ী নয় জ্ঞান বিজ্ঞানের বিরোধী।
আমরা আজ যে পশ্চিমা প্রগতিবাদের হুবহু অনুকরণে ব্যস্থ, সেই পশ্চিমা সমাজ আজ ধর্মহীন প্রগতিবাদের মর্মান্তিক পরিণতিতে ধুকছে। নারী-পুরুষের সহশিক্ষার যে ব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু রয়েছে তার ভয়াবহ পরিণতি ক্রমশই আমাদের সামনে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বলতে দ্বিধা নেই যে, ইভটিজিং প্রবণতাসহ সামগ্রীকভাবে সমাজের চারিত্রিক অধঃপতনের মুলে এই সহশিক্ষা অনেকাংশেই দায়ী।

সম্প্রতি আল্লামা আহমদ শফী সাহেবের একটি বক্তব্য নিয়ে তুমুল আলোচনা সমালোচনা ও রাজনীতি চলছে। তিনি মেয়েদেরকে ক্লাশ ফোর ফাইভের বেশি স্কুলে পড়াতে নিষেধ করেছেন। এও বলেছেন, “এর বেশি যদি পড়ান তবে আপনার মেয়ে আপনার থাকবে না।” এ কথাটা শতভাগ বাস্তব। অশীতিপর এই বয়ঃবৃদ্ধ আলেমের সরল মন্তব্য নিয়ে যতই রাজনীতি হোক না কেন, বাস্তবতা অন্যরকম। উনি স্কুল কলেজ ভার্সিটির ছাত্র ছাত্রীদের চারিত্রিক স্খলন এবং সমাজের নৈতিক অধঃপতনের চিত্রকে সামনে রেখেই কথাটা বলেছেন। উনি স্কুলে না পড়ানোর কথা বলেছেন, এটা মুলত এই সহশিক্ষার পরিণতির কথা চিন্তা করেই বলেছেন। অন্যথায় ইসলামে জ্ঞান অর্জনের নির্দেশ নর-নারী উভয়ের উপর এসেছে, এটা এই প্রখ্যাত বৃদ্ধ আলেমের অজানা নয়। 

আমাদের প্রগতিবাদী শিক্ষাবিদরা দেখলেন, পাশ্চাত্যে সহশিক্ষা প্রচলিত, তাই তারাও একে সভ্যতার সিড়ি মনে করে তার উপর আমল শুরু করে দিলেন। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেননি, Kinsey report (আমেরিকার প্রসিদ্ধ যৌনশাস্ত্রবিদ প্রফেসর আল ফ্রাইড্স কিনসী দীর্ঘ পনেরো বছর গবেষণার পর যে বিশ্ব বিখ্যাত রিপোর্ট তৈরী করেছিলেন) আমেরিকার সামাজিক ভয়াবহ অধঃপতনের যে চিত্র বিশ্ববাসির সামনে তুলে ধরেছে তার উপাদান কী?  আমাদের যুব সমাজের মধ্যে যৌন উশৃঙ্খলার বিস্তার যে দিন দিন বেড়েই চলেছে তার কারণ কী এবং এর দায় কিসের উপর বর্তায় তা-ও আমাদের প্রগতিবাদী সুশীলরা ভেবে দেখেননি।
আজ আমাদের অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, আইন ও সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মের গাইডেন্স নেয়া তো দূরের কথা বরং সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধর্মের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। সহশিক্ষা তো আছেই, তার সাথে এখন ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দিয়ে ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করার প্রচেষ্টা চলছে। যে পশ্চিমাদের অনুকরণে আমরা এগুলোকে সময়ের দাবি ভাবছি, সেই পশ্চিমারাই আজ ধর্মনিরপেক্ষতা এবং প্রগতিবাদের ভয়াল পরিণতিতে এমন এক সামাজিক বিপর্যয়ের শিকার, যা থেকে মুক্তির জন্য তাদের চিন্তাবিদগণ ধর্মকেই উত্তরণের একমাত্র পথ মনে করছেন। পশ্চিমী আইনবিদগণ আজ খুবই চিন্তিত যে, প্রগতিবাদের এই অপ্রতিরোধ্য সয়লাবের মাঝে এমন কী নীতি অবলম্বন করা যায়, যাতে কমপক্ষে কিছু উচ্চ মানবীয় গুণাবলী সংরক্ষিত ও অপরিবর্তনীয় থাকবে। এক মার্কিন বিচারপতি কার্ডোজো লিখেছেনঃ “আইনের জন্য আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হল, আইনের এমন এক মুলনীতি তৈরী করা যেটা হবে স্থির ও অপরিবর্তনীয় এবং বিদ্যমান পরিস্থিতির চাহিদাগুলোর মাঝে সমন্বয় বিধানকারী।” (ঞযব এৎড়ঃিয ড়ভ ঃযব খধ)ি এ বিষয়ে প্রখ্যাত আইন প্রণেতা জর্জ প্যাটন এর কথা সুস্পষ্টঃ- “আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি আদর্শ সমাজে কোন্ কোন্ বিষয়গুলো সংরক্ষণ করা উচিৎ? এটি মুল্যবোধ সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আইন দর্শন এতদসংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্ব পালন করে থাকে। কিন্তু এই ব্যাপারে আমরা দর্শনের কাছে যতই সাহায্য প্রার্থনা করি, ততই এই প্রশ্নের উত্তর মেলা কষ্টকর হয়ে পড়ে। কারণ, মূল্যবোধের এখন পর্যন্ত কোন সর্বসম্মত মাপকাঠি জানা যায়নি। বস্তুতঃ একমাত্র ধর্মই হল এমন একটি বস্তু যাতে আমরা এঁর একটি শক্ত ভিত্তি পাই। তবে ধর্মীয় তত্বকে কেবল যৌক্তিক প্রমাণ দিয়ে বিচার করলে চলবে না বরং গভীর অনুরাগ ও বিশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহন করতে হবে।”
কোরআনে কারীম ঘোষণা করেছেঃ- যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার পক্ষ হতে আগত নিদর্শন অনুসরণ করে, সে কি তার মত, যার কাছে তার মন্দকর্ম সমূহ ভাল বলে মনে হয় এবং সে তা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে? (সূরাহ মুহাম্মাদ-১৪) অতএব, আজ আমাদের উচিত, প্রগতিবাদের বৈধ-অবৈধের সীমা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা এবং এর পরিণতিকে যথার্থভাবে অনুধাবন করা। ইসলাম মানুষকে আধুনিকতার বিকাশের জন্য যে প্রশস্ত ক্ষেত্র দান করেছে তা গ্রহণ করা, এবং যে সব বিষয়কে অপরিবর্তনীয় বলে ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে অনধিকার চর্চা না করা। আমরা যদি ইসলামী মুল্যবোধ এবং ভাবধারার ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহন করি, নারী-পুরুষের জীবনপদ্ধতিতে ইসলাম যে সীমারেখা বেধে দিয়েছে, যে সংযত এবং পরিচ্ছন্ন বিধানাবলী নির্দিষ্ট করে দিয়েছে; সে অনুশাসন যদি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বাস্থবায়ন করতে পারি, তাহলে শুধু ইভটিজিং নয় অন্যান্য নৈতিকতা এবং চরিত্র সংশ্লিষ্ট অপরাধ প্রবণতাও ন্যুন্যতম পর্যায়ে নেমে আসবে।
------------------------------------------------
লেখকঃ সেলিম সামীর
প্রবন্ধকার ও কলামিস্ট, সিলেট।
email: shelim.sameer@gmail.com

No comments:

Post a Comment

Pages