মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Friday, August 27, 2021

শ্রীহট্ট থেকে পূণ্যভূমি সিলেট

পথে পথে বড় বড় পাথর ফেলে পথ আটকে দেওয়ার চেষ্ঠা করেছিল হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দ। শাহজালাল (রহঃ) পাথরকে আদেশ করেছিলেন- ‘সিল হট যাহ’ (পাথর সরে যা)। ওই আদেশে পাথরখন্ড সরে যায়। ‘সিল হট যাহ্’ আদেশ থেকে সিলহট নামটির জন্ম হয়, যা পরে সিলেট নামে পরিচিতি লাভ করে।

 

মুহাম্মদ আবদুল হামিদ

-----------------------------------

সে অনেক দিন আগের কথা। তখন সিলেটে মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো খুবই নগন্য। হিন্দু দেব-দেবীর নামের সাথে মিল রেখে সিলেটের নাম ছিল ‘শ্রীহট্ট’।


শ্রীহট্ট নামের সাথে হিন্দু পৌরাণিক আখ্যানের প্রভাব জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী শ্রী শ্রী হাটকেশ্বর হচ্ছে মহাদেব শিবের বহু নামের অন্যতম। তৎকালীন গৌড়(শ্রীহট্ট) রাজাদের কর্তৃক পুজিত শ্রী হাটকেশ্বরই শ্রীহট্ট নামের উৎস বলে অনেকে মনে করেন। কালক্রমে শ্রীহট্ট থেকে পূণ্যভূমি সিলেট নামে পরিচিতি লাভ করেছে।


সিল মানে শিলা বা পাথর। আর পাথরের প্রাচুর্য থাকার কারণে এ অঞ্চলের নাম সিলেট হয়েছে। তবে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়, হযরত শাহজালাল (রহঃ) সিলেটে আসার প্রেক্ষাপটেই এ অঞ্চলের নাম শ্রীহট্ট থেকে সিলেট হয়েছে। 


সবুজ বন-বনানী, উচু-নিচু টিলা-পাহাড় ঘেরা প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি শ্রীহট্টে মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো খুবই নগন্য। এর অধিকাংশ নাগরিক ছিলো হিন্দু ধর্মের অনুসারী। তখন শ্রীহট্টের রাজা ছিলেন গৌড় গোবিন্দ। তিনি ছিলেন কট্টর হিন্দু ও অত্যাচারী শাসক। অন্য ধর্মকে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। গৌড় গোবিন্দের কারণে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা সীমাহীন অত্যাচার-অনাচারে দিন কাটাতে হতো। তখন অল্প কিছু মুসলমান শ্রীহট্টে বসবাস করতেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন হযরত বুরহান উদ্দিন (রহঃ)।


বুরহান উদ্দিন (রহঃ) দীর্ঘদিন নিঃসন্তান থাকার পর আল্লাহর কৃপায় তাঁর ঘরে এক পুত্রসন্তানের জন্ম হলো। সস্তানের আকীকার জন্য তিনি আল্লাহর নামে একটি গরু জবাই করলেন। কট্টরপন্থী হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের এলাকায় তখন গরু জবাই করা নিষিদ্ধ ছিলো। গরু জবাইয়ের সংবাদ পেয়ে রাজা গৌড় গোবিন্দ ক্ষিপ্ত হলো। রাজার নির্দেশে বুরহান উদ্দিনকে গ্রেফতার করা হলো। নিষিদ্ধ থাকার পরেও গরু জবাই এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে বুরহান উদ্দিন (রহঃ) জানালেন, আকীকাহ করা ইসলামের বিধান। তাই তিনি পুত্রসন্তানের আকীকার জন্য গরু জবাই করেছেন। নিষ্ঠুর রাজা গৌড় গোবিন্দ যে সন্তানের জন্য গরু জবাই করা হয়েছে সেই শিশুকে এনে হত্যা করলেন এবং যে হাত দিয়ে বুরহান উদ্দিন গরু জবাই করেছেন সে হাত কেটে দিলেন।


বুরহান উদ্দিন (রহঃ) গৌড় গোবিন্দের এই নিষ্ঠুরতায় খুবই ব্যথিত হলেন। গভীর শোক ও ক্ষোভ নিয়ে তৎকালীন বাংলার শাসক শামসউদ্দীন ফিরোজ শাহের নিকট গিয়ে তাঁর প্রতি গৌড় গোবিন্দের এই নিষ্ঠুরতার কথা শোনালেন। শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের কাছে গৌড় গোবিন্দের জুলুম-অত্যাচার, নির্যাতন-নীপিড়ন ও ইসলাম বিদ্বেষ সম্পর্কে অভিযোগ জানালেন।


গৌড় গোবিন্দের নিষ্ঠুরতার কথা শোনার পর ফিরোজ শাহ তাঁর ভাগ্নে সিকান্দার গাজীর নেতৃত্বে গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে একটি সৈন্যবাহিনী পাঠালেন। কিন্তু যাদুবিদ্যায় পারদর্শী গৌড় গোবিন্দের সৈন্যরা সিকান্দার গাজী ও তার সৈন্যদের উপর অগ্নিবান নিক্ষেপ করতে লাগলো। এর ফলে সিকান্দার গাজী ও তাঁর সৈন্যরা অভিযানে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলেন।


গৌড়গোবিন্দের ইসলাম বিদ্বেষ, বুরহান উদ্দীনের সন্তান হত্যা ও সিকান্দার গাজীর অভিযানের ব্যর্থতার কথা দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীকে জানানো হলো। এসব জানার পর তিনি শ্রীহট্টের অত্যাচারী শাসক গৌড় গোবিন্দকে শায়েস্তা করার জন্য একটি শক্তিশালী বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। শ্রীহট্টের চারপাশে নদী। সবগুলো নদীর উপর গৌড় গোবিন্দের নিয়ন্ত্রণ ছিলো। এছাড়াও তারা কালো যাদুবিদ্যায় পারদর্শী ছিলো। এদের সাথে সাধারণ কোন সেনাপতির নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করে লাভ হবে না, বিষয়টি জানতে ও বুঝতে পারলেন আলাউদ্দীন খিলজী। তিনি ভাবলেন এদের শায়েস্তা করার জন্য অভিযান পরিচালনায় অত্যন্ত ঈমানদার ও আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন কোন মহৎ ব্যক্তির নেতৃত্বের প্রয়োজন।


এসব গুণের অধিকারী ছিলেন সৈয়দ নাসির উদ্দীন (রহঃ)। তিনি ছিলেন ঈমানদার ও আধ্যাত্মিকতার গুণে গুণান্বিত পূণ্যবান ব্যক্তি। আলাউদ্দীন খিলজী সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে অভিযানে পাঠালেন। এ সময় বুরহান উদ্দীন দিল্লীতে নিজামউদ্দিন (রহঃ) -এর দরবারে উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় দিল্লীতে আগমণ করেন বিশ্ববিখ্যাত দরবেশ হযরত শাহজালাল (রহঃ)। তিনি বুরহান উদ্দিনের কাছ থেকে গৌড় গোবিন্দের নিষ্ঠুরতা ও ইসলাম বিদ্ধেষের কথা জানার পর শাহজালাল (রহঃ) শ্রীহট্টে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। শাহজালাল (রহঃ) ইয়েমেন থেকে এসছেন। তখন তার সঙ্গী ছিলেন ২৪০ জন।


সবাইকে সাথে নিয়ে তিনি শ্রীহট্টে আসার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। এমতাবস্থায় হযরত শাহজালাল (রহঃ)-এর সাথে আলাউদ্দিন খিলজীর প্রেরিত সেনাপতি সৈয়দ নাসির উদ্দিনের দেখা হলো। শাহজালালের শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে অবগত হয়ে নাসির উদ্দিন তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।


ইতিহাস থেকে জানা যায়, সৈয়দ নাসির উদ্দীনের অধীনে এক হাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার পদাতিক সৈন্যসহ শাহজালাল (রহঃ) নিজ সঙ্গীদের নিয়ে সোনারগাঁ এর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সোনারগাঁ এসে সিকান্দর গাজীর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। সিকান্দার গাজী শ্রীহট্ট ও রাজা গৌড় গোবিন্দ সম্পর্কে অবহিত করলেন। এরপর সবাই এক সাথে শ্রীহট্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।


তখন হযরত শাহজালাল (রহঃ) -এর আধ্যাত্মিকতা ও আদর্শের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে সিকান্দার গাজী নিজেও শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। এভাবে পথে পথে অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে শ্রীহট্টে এসে পৌছার আগ পর্যন্ত ৩৬০ জনে পৌছালো। খবর পেয়ে রাজা গৌড় গোবিন্দ ব্রহ্মপুত্র নদীতে সকল প্রকার নৌকা চলাচল বন্ধ করে দিলেন।


হযরত শাহজালাল (রহঃ) অনুসারী ও অনুগত বাহিনীকে নিয়ে নদী পার হয়ে অগ্রসর হলেন। জানা যায়, তাঁরা সবাই জায়নামাজে চড়ে অলৌকিকভাবে নদী পাড় হয়েছিলেন। ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে নবীগঞ্জের দিনারপুর পরগণা হয়ে শ্রীহট্টের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। খবর পেয়ে গোবিন্দ এবার সুরমা নদীতে নৌকা চলাচল বন্ধ করে দেয়। গোবিন্দ ভাবছিলো খরস্রোতা সুরমা নদী পার হতে সক্ষম হবে না মুসলিম বাহিনী। কিন্তু আল্লাহর প্রিয় বান্দা হযরত শাহজালাল (রহঃ) পূর্বের মতো জায়নামাজের সাহায্যে নদী পার হলেন।


এছাড়া পথে পথে বড় বড় পাথর ফেলে পথ আটকে দেওয়ার চেষ্ঠা করেছিল হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দ। শাহজালাল (রহঃ) পাথরকে আদেশ করেছিলেন- ‘সিল হট যাহ’ (পাথর সরে যা)। ওই আদেশে পাথরখন্ড সরে যায়। ‘সিল হট যাহ্’ আদেশ থেকে সিলহট নামটির জন্ম হয়, যা পরে সিলেট নামে পরিচিতি লাভ করে।


গোবিন্দের সর্বশেষ অস্ত্র ছিলো তার যাদুমন্ত্র। শাহজালাল (রহঃ) -এর বাহিনীর উপর গোবিন্দের যাদুমন্ত্র ব্যর্থ হতে থাকলো। গোবিন্দের সকল কৌশল যখন বিফল হয়ে গেল তখন শেষ চেষ্টা হিসেবে রাজা গোবিন্দ এক বিশালাকার লৌহধনুক যাদুমন্ত্র করে দিয়ে শাহজালাল (রহঃ) -এর কাছে পাঠালো এবং শর্ত দিলো- কেউ যদি একা উক্ত ধনুকের সাহায্যে তীর মারতে পারে তাহলে গোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে।


হযরত শাহজালাল (রহঃ) তাঁর দলের লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, যে ব্যক্তি কখনও ফজরের নামাজ কাজা করেনি বা বাদ দেয়নি একমাত্র সেই পারবে এই বিশাল লৌহধনুক দিয়ে একা তীর মারতে। পাওয়া গেল সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে। নাসির উদ্দিন সফল হলেন। রাজা গোবিন্দ গোপনে রাজ্য ছেড়ে  চলে গেল। কিছুক্ষণ পর সিলেটে প্রথমবারের মত ধ্বনিত হল আযানের সুর ‘আল্লাহু আকবার’। কথিত আছে, আজানের ধ্বনিতে গৌড় গোবিন্দের প্রসাদ ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।


১৩০৩ সালে প্রায় বিনাযুদ্ধে সিলেট জয় করলেন হযরত শাহজালাল (রহঃ)। তিনি তার শিষ্য সিকান্দার শাহকে রাজ্য পরিচালনা ও শাসনভার এর দায়িত্ব দিয়ে নিজে ধর্মের খেদমতে আত্মনিয়োগ করলেন। সিকান্দার শাহ প্রথমেই জায়গার নাম ‘শ্রীহট্ট’ থেকে ‘জালালাবাদ’ রাখলেন। জালালাবাদে মাদ্রাসা, মক্তব, প্রজাদের যাতায়াতের রাস্তাঘাট, বিশ্রামাগার ও বিশুদ্ধ পানির জন্য নলকূপ স্থাপন করা হলো। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে জালালাবাদ থেকে ‘সিলেট’ নামে পরিচিতি লাভ করে।


সিলেট তথা গোঠা বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে হযরত শাহজালাল (রহঃ) ও তাঁর সফরসঙ্গী ৩৬০ জনের অবদান অনস্বীকার্য। শাহজালাল (রহঃ) এর আধ্যাত্বিকতা, কারামত, উদারতায় মুগ্ধ হয়ে এ অঞ্চলের লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করলো। মানুষ পেল সত্যের দিশা। খোঁজে পেল নিজেদের জীবনকে আলোকিত করার ধর্ম দ্বীন ইসলামকে। হিন্দু দেব-দেবীর নামের সাথে মিলিয়ে রাখা ‘শ্রীহট্ট’ থেকে এ অঞ্চলের নাম হয়ে গেল আধ্যাত্মিক রাজধানী পূণ্যভূমি ‘সিলেট’।


-------------------------

মুহাম্মদ আবদুল হামিদ

শিক্ষক : জামেয়া আনওয়ারে মদিনা, পশ্চিম ভাটপাড়া, ইসলামপুর, সিলেট।



No comments:

Post a Comment

Pages