![]() |
👉মুহাম্মদ আবদুল হামিদ |
হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে জিলহজ মাসের ৯ তারিখ পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হয়। হজের সময় বিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান কা’বা শরীফে এসে সমবেত হন। বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলে কাঁধেকাঁধ মিলিয়ে সাদা রঙের সেলাই বিহীন বিশেষ দু’টি পোশাক পড়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিতির স্বীকৃতি দেন। তারা নিজেদের উপস্থিতি ও একত্ববাদের স্বীকৃতি স্বরূপ ঘোষণা করেন—‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাক।’ অর্থ- ‘আমি হাজির তোমার সান্নিধ্যে, হে আল্লাহ! আমি হাজির তোমার দরবারে, আমি হাজির তোমার দরজায়, তোমার কোনো শরীক নেই, আমি হাজির তোমার দরগায়। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা, সকল নিয়ামত তোমারই, আর তোমার রাজ্যে তোমার কোনো অংশীদার নেই।’
হজের আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে হাজিরা ৭ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় অবস্থান করেন। ৭ জিলহজ মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মিনার উদ্দেশে যাত্রা করেন। ৮ জিলহজ সারাদিন মিনায় থাকেন। ৯ জিলহজ ফজরের নামাজের পর তারা আরাফাতের ময়দানে যাবেন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। এরপর আরাফাত ময়দান থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে মুজদালিফায় রাত্রীযাপন করবেন এবং জামারাতে পাথর নিক্ষেপের জন্য ৭০টি কঙ্কর সংগ্রহ করেন। ১০ জিলহজ ফজরের নামাজের পর মুজদালিফা থেকে মিনায় ফিরে বড় জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ, কোরবানি ও মাথা মুণ্ডন করে স্বাভাবিক পোশাকে মক্কায় কাবা শরিফ তাওয়াফ করেন। তাওয়াফ ও সাঈ শেষে হাজিরা মিনায় ফিরে ১১ ও ১২ জিলহজ তিনটি জামারায় প্রতিদিন ২১টি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। হজের আগে বা পরে হাজিরা মদিনায় গমণ করে থাকেন। সেখানে মসজিদে নববীতে নামাজ আদায় ও রাসূল (সা.)-এর কবর জিয়ারত করেন। মদিনায় রাসল (সা.)-এর স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান দর্শন করেন।
হজের সফর অনেক দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য। এতে ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো অনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। আর তা হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। লোক দেখানো হজ পালন কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। হজের সময় সেলফি তোলা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড দেওয়ার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।
হজ মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমাবেশ। হজের সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলমানরা জাতি, গোত্র, বর্ণ ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে একই স্থানে মিলিত হয়। এতে রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু, আরব-অনারব, নারী-পুরুষ সবার মধ্যে একটি সাম্যভাব প্রতিষ্ঠা করে। সঙ্গে সঙ্গে হজ আদায়কারীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসা জাগ্রত হয়। হজের সময় এক ইমামের অনুসরণ করে মুসলমানরা বিশ্বকে জানিয়ে দেয়, আমরা এখনও ঐক্যবদ্ধ। বাংলাদেশ থেকে এবার ৮৭ হাজার ১০০ মুসল্লি হজ পালন করবেন। গত বছর সারাবিশ্বের প্রায় ১৮ লাখ মুসল্লী হজ পালন করেছিলেন। যারমধ্যে বিদেশি ছাড়াও সৌদির নাগরিক ও দেশটিতে বসবাস করা মানুষ ছিলেন। তবে গত বছর অনেকে অনুমতি না নিয়ে হজ করতে গিয়ে তীব্র দাবদাহের কবলে পড়েন। এতে প্রায় ১ হাজার ৩০০ হাজীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল। এবার সৌদি সরকার বিশৃঙ্খলা এড়াতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এবার মক্কায় প্রবেশের জন্য অনুমতি বাধ্যতামূলক করেছে। হজযাত্রীকে অবশ্যই ‘নুসুক’ (ঘঁংঁশ) নামের সরকারি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে হজ পারমিট সংগ্রহ করতে হবে। যাদের কাছে বৈধ কাগজপত্র থাকবে না, তাদের শহরের চারপাশে স্থাপিত নিরাপত্তা চৌকিতে ফেরত পাঠানো হবে।
কা’বা ঘরে সর্বপ্রথম হজ আদায় করেছিলেন হযরত আদম (আ.)। তারপর অন্যান্য নবী-রাসূলগণ এ দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সময় থেকে হজ ফরয বা আবশ্যকীয় ইবাদত হিসেবে নির্ধারিত হয়। ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর হুকুমে সিরিয়া থেকে হিযরত করে কা’বা শরীফের অদূরে নির্জন ভুখন্ডে আসেন। সে সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে তিনটি নির্দেশ প্রদান করেন— ১. আমার ইবাদাতে কাউকে শরীক করো না। ২. আমার গৃহকে (কা’বাগৃহকে) পবিত্র রাখো। ৩. মানুষের মধ্যে বায়তুল্লাহর হজ ফরজ হওয়ার ঘোষণা দাও।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এ আদেশের পর হযরত ইব্রাহিম (আ.) মাকামে ইব্রাহীমে দাড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে হজের ঘোষণা দেন। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে- হযরত ইব্রাহীম (আ.) আবু কোবাইস পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে অঙ্গুলি রেখে ডানে-বামে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে ঘোষণা করেছিলেন— ‘লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর এই গৃহের হজ ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন করো।’ ওই বর্ণনায় আরো উল্লেখ আছে— হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর এই ঘোষণাটি মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর কুদরতের মাধ্যমে বিশ্বের সবখানে পৌঁছে দেন। শুধু তখনকার সময়ের জীবিত মানুষ পর্যন্ত নয়; বরং ভবিষ্যতে কেয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীতে আগমনকারী ছিলো, তাদের সবার কান পর্যন্ত এ ঘোষণার আওয়াজ পৌছে দেয়া হয়। যার যার ভাগ্যে আল্লাহ তা’লা হজ লিখে দিয়েছেন তাদের প্রত্যেকেই এই আওয়াজের জবাবে ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলেছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ইব্রাহীমি আওয়াজের এই জওয়াবই হলো হজে ‘লাব্বাইকা’ বলার মূল ভিত্তি। (তাফসিরে মা’রিফুল কুরআন)।
রাসূল (সা.)-এর কাছে ৯ম হিজরীতে হজ ফরজ হওয়ার আয়াত অবতীর্ণ হয়। তবে কোনো কোনো বর্ণনায় ৫ম অন্য বর্ণনায় ৬ষ্ঠ হিজরীতে উম্মাতে মুহাম্মাদী (সা.)-এর উপর হজ ফরজ হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অষ্টম হিজরির রমজান মাসে মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (সা.) ওমরাহ সম্পাদন করেছিলেন। দশম হিজরিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায় সোয়া লাখ সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে হজ সম্পাদন করেন। এই হজই ঐতিহাসিক ‘বিদায় হজ’ নামে পরিচিত।
হজ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ— ইচ্ছা করা, সাক্ষাত করা, সফর করা, ভ্রমণ করা ইত্যাদি। হজ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান। ইসলামের পরিভাষায় হজ বলা হয়— আল্লাহর সন্তুষ্ঠি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের নির্ধারিত দিনসমুহে বিশেষ পদ্ধতিতে বাইতুল্লাহর ঘর ও সংশ্লিষ্ট স্থানসমুহ যিয়ারত করা। অর্থাৎ— পবিত্র ঘর কা’বা শরীফ প্রদক্ষিণ করা, আরাফাত ও মুজদালাফায় অবস্থান করা ইত্যাদি। জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ হজের জন্য নির্ধরিত সময়।
শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ আদায় করা ফরজ। এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন- ‘যে সকল মুসলমানদের পথের সামর্থ আছে, তাদের ওপর আল্লাহর জন্য হজ পালন করা কর্তব্য। ’ (সূরা আলে ইমরান- ৯৭)।
আল্লাহর সন্তুষ্টির আসায় সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যারা হজ আদায় করে তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত রহমত ও বরকত। হজ আদায় করতে প্রচুর অর্থ সম্পদ ব্যয় হওয়ার কারণে সম্পদ কমে যায় না। এক বর্ণনায় রয়েছে— আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হজ ও ওমরাহ সফরের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য রেখেছেন যে, দূর-দূরান্ত থেকে হজে আগমন করতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় এর কারণে পার্থিব দারিদ্র্য ও উপবাসে নিমজ্জিত হতে হয় না; বরং হজ ও ওমরায় ব্যয় করলে দারিদ্র্যতা ও অভাবগ্রস্ততা দূর হয়ে যায়। অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলতা আসে। এ প্রসংঙ্গে আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে— ‘দূর-দূরান্ত থেকে যারা এসে উপস্থিত হয়, তা তাদেরই উপকারে নিমিত্ত।’ (সূরা হজ- ২৯)।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘হজ্জে মাবরুর বা কবুল হজের বিনিময় হলো জান্নাত।’ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্যে হজ করে এবং তাতে অশ্লীল ও গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে হজ থেকে এমতাবস্থায় ফিরে আসে, যেন সে আজই মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়ে এসেছে; অর্থাৎ জন্মের অবস্থায় শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, সে-ও তদ্রুপই হয়ে যায়। (বোখারী-মুসলিম)।
হজ আদায়ের জন্য আর্থিক সামর্থ থাকার পাশাপাশি শারিরিক সামর্থ থাকাও জরুরী। হজ ফরজ হওয়ার পর যদি পরবর্তীতে কোনো ব্যক্তি সম্পদহারা হয়ে যায় বা শারিরিক সামর্থ হারিয়ে ফেলে তবে তার ওপর ফরজ হজ হওয়ার হুকুম রহিত হবে না। সুতরাং প্রত্যেক সামর্থবানের জন্য উচিৎ— ইসলাম ধর্মের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফরজ এই বিধানটি সঠিক সময়ে আদায় করে নেওয়া। এমনও হতে পারে বিলম্ব করার কারণে অসুস্থতা এসে যেতে পারে কিংবা আর্থিক সামর্থ নাও থাকতে পারে। মৃত্যু কখনজানি এসে যায়! সম্পদ কখনজানি বিলীন হয়ে যায়! হজ ফরজ থাকা অবস্থায় যদি মৃত্যু হয় তাহলে পরিণতি ভালো হবে না।
সময়মত হজ আদায় না করার পরিণতি সম্পর্কে হাদিস শরীফে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন— ‘যে ব্যক্তির মক্কা শরীফ যাতায়াতের সম্বল সামর্থ রয়েছে কিন্তু হজ আদায় করেনি, সে যেন ইহুদী বা খৃষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করে।’ (মুসলিম)।
-------------------------------
মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
শিক্ষক ও প্রবন্ধকার
Email : hamidsylbd@gmail.com
No comments:
Post a Comment