মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Tuesday, July 31, 2018

যিনা ব্যাভিচার ও ধর্ষণ প্রতিরোধে ইসলাম

লিখেছেন-মাওলানা আবদুল হামিদ

ব্যাভিচারের বিরুদ্ধে শাস্তির কোন বিধান না থাকার কারণেই ধর্ষণের প্রবণতা বেড়ে চলছে। সম্মতি আর অসম্মতির বিভাজন থাকায় সম্মতিতে হওয়া ব্যাভিচার দেদারসেই চলছে। একই ব্যক্তি তার স্ত্রী ভিন্ন অন্য নারীর সাথে দৈহিক সম্পর্ক করে যখন পার পেয়ে যাবে, তখন সে এক পর্যায়ে জোরপূর্বকও তা করতে চাইবে।
--------------------------------------------------------------------------------
ধর্ষণ একটি গুরুতর অপরাধ। মারাত্মক একটি সামাজিক ব্যাধি। বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন মানুষের লাগামহীন পাশবিক বহিঃপ্রকাশই এই ব্যাধি সৃষ্টির মূল কারণ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কম-বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারতে প্রতিনিয়ত এরকম ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটতে শুনা যায়। ইদানিং বাংলাদেশেও এর প্রবণতা অনেকটা বেড়ে গেছে। রেলে, চলন্ত গাড়ীতে, শিক্ষা প্রতিষ্টানে, ধানের ক্ষেতে যেখানে সেখানে ঘটছে ধর্ষণের মত ন্যাক্কারজনক পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা।

চিকিৎসক, মসজিদের ইমাম, বাবার দ্বারা মেয়ে ধর্ষিত এমন শিরোনাম দেখে আমরা অবাক হই আর ভাবি আমাদের সমাজ কতটা অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পত্র-পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুললেই ধর্ষণ, পাশবিক নির্যাতনসহ এমনসব খবর দেখা যায়, যেগুলো সামাজিক অবক্ষয় ও অবনতির ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরে। কোমলমতি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না লম্পট লুচ্ছাদের হাত থেকে। গত ১৭ জুলাই একদিনেই একাধিক পাশবিক নির্যাতনের ন্যাক্কারজনক খবর দেখে গায়ের লোম শিউরে উঠলো। সিলেট ওসমানি মেডিকেলে নানীর চিকিৎসকের দ্বারা নাতনী ধর্ষিত। সোমবার ভোর রাতের দিকে হাসপাতালের তৃতীয় তলার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে এই ঘটনা ঘটে। নাক কান গলা বিভাগের ইন্টার্নি চিকিৎসক রাতে ফাইল দেখার কথা বলে ঐ কিশোরিকে ডেকে নেয় এবং সেখানে তাকে ধর্ষণ করে। জকিগঞ্জে ইমামের দ্বারা ৪র্থ শ্রেণীর শিশু ধর্ষিত হয়েছে। স্কুল ছুটির পর বাড়ী যাওয়ার সময় হাজারীচক পশ্চিম মহল্লা নতুন পাঞ্জেগানা মসজিদের ইমাম মেয়েটিকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে শরবতের সাথে ঘুমের বড়ি মিশিয়ে অচেতন করে পাশবিক নির্যাতন করেছে। মাধবপুরে কিশোরি গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার পূর্ববাগ গ্রামের জিতু মিয়ার কিশোরী কন্যাকে মাধবপুরের আন্দিউড়া ইউনিয়নের মীরনগর গ্রামে নিয়ে ৭/৮ জন লম্পট পালাক্রমে গণধর্ষণ করে।
(সুত্র- দৈনিক জালালাবাদ, ১৭ জুলাই ২০১৮ ইংরেজি) ২য় শ্রেণীর ছাত্রী ১০ বছরের শিশু মেয়েকে ধর্ষণ করল তার সৎ বাবা। সিলেট নগরীর দর্জিপাড়ায় দুই মাস ধরে মেয়েটিকে ধর্ষণ করছিল বগুড়ার গাবতলি থানার সরধনকুঠি গ্রমের পিটু মিয়া। (সুত্র- দৈনিক শ্যামল সিলেট, ১৮ জুলাই ২০১৮ ইংরেজি) বর্তমানে আশংকাজনক হারে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু ধর্ষণের রায় হয়েছে, শাস্তি পেয়েছে এমন নিউজ খুব কমই পাওয়া যায়। অপরাধীরা শাস্তি না পাবার কারণে অপরাধ প্রবণতা খুব স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। আমাদের দেশেও তাই ঘঠছে।

বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা হচ্ছে- “যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ব্যতীত বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতীত যৌন সঙ্গম করে, তাহলে সেই ব্যক্তি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে৷” ধর্ষণের সর্বোচ্ছ শাস্তি মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড, অর্থদন্ডসহ কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে ধর্ষণের সংজ্ঞায় সম্মতি ও অসম্মতির বিষয়টি আলাদা করা হয়েছে। উভয়ের সম্মতিতে বিবাহ বহির্ভুত যৌন সঙ্গম করলে কোন শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। এবং নারীর একটা বয়স সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট বয়স উল্লেখ করেনি এবং সম্মতি অসম্মতির বিষয় আলাদা করে নি। বরং বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ককেই যিনা বলেছে, যা দন্ডনীয় অপরাধ। এক্ষেত্রে নারীর সম্মতি থাকলে সেও শাস্তি পাবে। তবে ইসলামে যে কোনো বিধান প্রযোজ্য হওয়ার জন্য বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া জরুরী। আর বালেগ হওয়ার বয়স ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হতে পারে। স্বেচ্ছায় কেউ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক করলে তাকে বালেগই ধরা হবে। কাজেই তার ওপরও শাস্তি প্রযোজ্য হবে। উভয়ের সম্মতিতে অবৈধ যৌনসঙ্গম ধর্মীয় দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও বাংলাদেশের আইনে এর কোন বিচারের বিধান নেই। বর্তমান সময়ে ব্যাভিচার একটি মহামারীর রূপ ধারণ করেছে। এবং এর প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। ব্যাভিচারের বিরুদ্ধে শাস্তির কোন বিধান না থাকার কারণেই ধর্ষণের প্রবণতা বেড়ে চলছে। সম্মতি আর অসম্মতির বিভাজন থাকায় সম্মতিতে হওয়া ব্যাভিচার দেদারসেই চলছে। একই ব্যক্তি তার স্ত্রী ভিন্ন অন্য নারীর সাথে দৈহিক সম্পর্ক করে যখন পার পেয়ে যাবে, তখন সে এক পর্যায়ে জোরপূর্বকও তা করতে চাইবে। কাজেই বিবাহ বহির্ভুত নারী-পুরুষের সম্মতিতে হওয়া যৌন সঙ্গম তথা যিনা-ব্যাভিচারের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ষণকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। কারণ ইসলামে ধর্ষণ ভিন্ন কোনো অপরাধ নয়, বরং বিবাহ বহির্ভূত যে কোনো যৌন সঙ্গমই ইসলামে অপরাধ। যাকে “যিনা” শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। যিনা সুস্পষ্ট হারাম যা শিরক ও হত্যার পর সবচেয়ে বড় অপরাধ। ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ষণে দুইটি অপরাধ হয়, ১. ব্যাভিচার ২. জুলুম বা কারো থেকে অন্যায়ভাবে কিছু কেড়ে নেওয়া। এখানে নির্যাতিত ব্যক্তি সম্পুর্ণ নির্দোষ। ধর্ষণের ক্ষেত্রে একপক্ষে যিনা সংঘটিত হয়। আর অন্যপক্ষ হয় মজলুম বা নির্যাতিত। তাই মজলুমের কোনো শাস্তি নেই। কেবল জালিম বা ধর্ষকের শাস্তি হবে। স্বেচ্ছায় অবৈধ যৌন সম্পর্ক করাকে ব্যাভিচার বলা হয়। এটি একটি সম্পর্ক হলেও ধর্মীয় দৃষ্টিতে যা অবৈধ, আর তাই এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। 

ব্যাভিচারের শাস্তি ব্যক্তিভেদে একটু ভিন্ন। ব্যাভিচারকারী যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। আর যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে একশত ছড়ি বা বেত্রাঘাত মারা হবে। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য একই শাস্তি। এ বিষয়ে আল-কুরআনে বর্ণিত হচ্ছে- “ব্যভিচারিণী নারী, ব্যভিচারী পুরুষ; তাদের প্রত্যেককে একশ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর করতে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। (সূরা নূর: ২)

হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “অবিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে শাস্তি এক শত বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে একশত বেত্রাঘাত ও রজম (পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড)। (সহীহ মুসলিম)

সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বেগ জনক ভাবে একের পর এক ধর্ষণের মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণকারী যাতে কোন আইনের ফাকে বা রাজনৈতিক কলা-কৌশলে পার না পায় সে দিকে সতর্ক হতে হবে। ধর্ষণকারীর শাস্তি প্রয়োগ করে সমাজে প্রচার করতে হবে যাতে অন্য অপরাধিরা ভয়ে অপরাধের দিকে পা না বাড়ায়। সামাজিকভাবেও ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে কঠোর প্রদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে নৈতিকতা শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত হয় এমন শিক্ষাই মানুষকে পাপাচার, নৈরাজ্য, অরাজকতা থেকে বিরত রাখতে পারে। বাংলাদেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। বেড়েছে নারী শিক্ষার হারও। বিভিন্ন পেশায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু কমেছে নারীর নিরাপত্তা। নারীরা নানাবিদ নির্যাতন ও পাশবিকতার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ ক্ষেত্রে নারী পুরুষ উভয়কেই পর্দার বিধান মেনে চলতে হবে। পর্দা নারীর ইজ্জত সম্ভ্রম হেফাজতের রক্ষাকবচ। পর্দার বিধানই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। ধর্ষণ, জেনা-ব্যাভিচার ঠেকাতে আল কুরআনে পর্দার বিধান সম্পর্কে ঘোষণা করা হয়েছে- “হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিন নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু” (সূরা আহযাব : ৫৯)। অন্য আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে- “(হে নবী!) মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। তারা যেন সাধারণত যা প্রকাশ থাকে তা ছাড়া নিজেদের আভরণ প্রদর্শন না করে” (সূরা নূর :৩১)।

****

মাওলানা আবদুল হামিদ
কলামিস্ট।
শিক্ষক : জামেয়া ইসলামিয়া আরওয়ারে মদিনা মাদ্রাসা, সিলেট।
মোবাইল : ০১৭১০৩৩৭০৭৭
Email : hamidsylbd@gmail.com

No comments:

Post a Comment

Pages