মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Monday, December 31, 2018

রাজনীতির একাল-সেকাল

গণতন্ত্রের মহান প্রবক্তা আব্রাহাম লিংকনের মতো, আমরা বলতে চাই, অর্ধেক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আর অর্ধেক মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা বিরোধী লোক নিয়ে বাংলাদেশের কখনো কাংখিত অগ্রগতি অর্জন সম্ভব নয়। সৌভাগ্যের বিষয়, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে এখন স্বাধীনতা বিরোধী কেউ নেই, আছে বিভিন্ন মত ও আদর্শের মানুষ, আমরা দৃঢ়ভাবে এটা বিশ্বাস করি। একসময় স্বাধীনতা বিরোধী থাকলেও এদের সংখ্যা ছিলো অতি নগণ্য। এদেশে পাকিস্তান কিংবা ভারত বিরোধী লোক থাকতে পারে, তবে স্বাধীনতা বিরোধী কেউ নেই’। আর এটাই আমাদের শক্তির উৎস।
-------------------------------------
নিজাম উদ্দীন সালেহ
-------------------------------------
যুক্তরাষ্ট্র থেকে দাসপ্রথার উচ্ছেদকারী মহান গণতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, অর্ধেক স্বাধীন এবং অর্ধেক দাস অর্থাত পরাধীন জাতি কখনো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না।
শেষ পর্যন্ত তিনি জীবন উতসর্গ করেছিলেন তার আদর্শ বাস্তবায়নে। যুক্তরাষ্ট্রে দাস প্রথা উচ্ছেদ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছিলেন তিনি। তার মতো মহান নেতাদের রক্ত ও প্রাণোতসর্গের কারণে যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। কিন্তু বাংলাদেশে যখন একটি প্রধান দলের শীর্ষ নেতা সম্প্রতি বলেন, ‘দেশ আজ দুইভাগে বিভক্ত। একটি পক্ষ হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের এবং অপরটি বিপক্ষের’। শুনে বিস্মিত হতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব  বিরোধী কোন লোক আদৌ আছে কি-না এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
এদেশের নাগরিক ছাড়াও যারা এদেশের নিমক অর্থাত খাদ্য খাচ্ছে, এদেশে জীবন-যাপন ও জীবন ধারণ করছে, তারা কীভাবে  এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যাবে, তা ভাবা যায় না, দুইভাগে বিভক্তি তো উদ্ভট ও কাল্পনিক বিষয়।তার বক্তব্য সঠিক হলে এদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার অর্ধেকই অর্থাত ৮ কোটিই মুক্তিযুদ্ধ অর্থাৎ স্বাধীনতা বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে এ ধরণের বক্তব্য যেমন ঢাহা মিথ্যে তেমনি দুরভিসন্ধিমূলক। জাতিকে যারা বিভক্ত করে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ হাসিল করতে চায়, তারাই এমন কথা বলতে পারে।
এভাবে এদেশে যখন উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও গণতন্ত্রের স্বার্থে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন সর্বাধিক, তখন একশ্রেণির রাজনীতিক জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করার প্রচেষ্টা চালাতে দেখা যাচ্ছে। অতীতে রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের এ ধরণের রাজনৈতিক কুটিলতা ও বিদ্বেষমূলক দৃষ্টিভঙ্গী লালন বা পোষণ করতে দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সহ সকল জাতীয় নেতাকে জাতীয় ঐক্যের এই আদর্শ মেনে চলতে দেখা গেছে। আগের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং বর্তমান সময়ের দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে এটা একটি বড়ো ধরণের পার্থক্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্বেও আগের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মাঝে সৌজন্যবোধ, সম্প্রীতি, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক সহানুভ‚তির ঘাটতি ছিলো না। দেশ বিভাগের আগে সিলেটের কৃতী সন্তান আমীনুর রশীদ চৌধুরী ছিলেন চিন্তা চেতনায় কংগ্রেসপন্থী। অপরদিকে ধলাবারি ছিলেন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী স্থানীয় নেতা। এক সময় এক সভায় কংগ্রেসপন্থী ও মুসলিম লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে মারামারির সূত্রপাত হলে উক্ত ধলাবারির লাঠির আঘাত লাগে আমিনুর রশীদ চৌধুরীর মাথায়। এতে তিনি সামান্য আহত হন। পরদিন ধলাবারি আমিনুর রশীদ চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে হাজির হন। জিজ্ঞেস করেন, আঘাতটা জোরে লাগেনি তো? এই ছিলো রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ ও সহমর্মিতা। ঘটনাটি আমিনুর রশীদ চৌধুরীর মুখ থেকে শোনা। আর এখন অন্য দলের আহত লোকজনের প্রতি সহানুভ‚তি প্রদর্শন দূরে থাক, নিজ দলের নেতাকর্মীদের হত্যা কিংবা গুরুতর জখম করেও একটু মর্মাহত বা দুঃখিত হতে দেখা যায় না নেতা-কর্মীদের, বাড়িতে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া বা দুঃখ প্রকাশ তো দূরের কথা।
আমি সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম না কোনদিন। যদিও ডানপন্থী রাজনীতির কাছাকাছি বা ঘনিষ্ট ছিলাম এক সময়। লক্ষ্য করেছি, আমি  ডানপন্থী আদর্শের অনুসারী হলেও অনেক বামপন্থী লোক আমাকে ভালোবাসতেন অকৃত্রিমভাবে, কাছে পেলে খুশী হতেন। এমনকি ডেকে নিতেন। এমসি কলেজে ইংরেজী অনার্স পড়াকালীন আমার সাবসিডিয়ারী সাবজেক্টের একটি ছিলো দর্শন। দর্শনের খ্যাতিমান অধ্যাপক ছিলেন সাধনকৃষ্ণ বড়–য়া। ইংরেজী বিষয়েও তিনি মাস্টার্স ডিক্রিধারী ছিলেন। সাধনকৃষ্ণ স্যার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীও স্বঘোষিত নাস্তিক ছিলেন। আমার রাজনৈতিক আদর্শ ও বিশ্বাস সম্পর্কে জানা সত্বেও তিনি আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। আমি তার নাস্তিক্যবাদী বক্তব্যের প্রতিবাদ করলে কিংবা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলে তিনি হেসে বলতেন, তোমার মাথায় একটা বিশ্বাস সেট হয়ে গেছে, তোমাকে আমি বুঝাতে পারবো না।
বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক বেলাল মোহাম্মদ ছিলেন খ্যাতিমান কবি ও মুক্তিযোদ্ধা। তিনিও আমাকে অকৃত্রিম ভালোবাসতেন, মাঝে মাঝে তার কাষ্টঘরের সরকারী রিক্যুইজিশন করা বাসায় যেতে অনুরোধ করতেন। সেখানে ছেলেকে নিয়ে তিনি থাকতেন। সাহিত্য ও রাজিৈতক বিভিন্ন বিষয়  নিয়ে আলোচনা হতো। ডানবাম সকল মত ও পথের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কবি-সাহিত্যিকরা সেখানে আসতেন। আলোচনা তর্কবিতর্ক ও আপ্যায়ন হতো স্যেহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে।
সত্তরের দশকের শেষভাগে এসেও রাজনীতি কিংবা ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্রবাজি ছিলো না। আমি এমসি কলেজে একটি ডানপন্থী ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলাম। আর এটাই ছিলো আমার রাজনৈতিক জীবনের শেষ সোপান। এরপর জড়িয়ে পড়ি লেখালেখি ও সাংবাদিকতায়। তখন এমসি কলেজে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের দোর্দান্ত প্রতাপ। ছাত্র শিবিরেরও প্রভাব ছিলো যথেষ্ট।
তখনকার সময়ে এমসি কলেজ কিংবা অন্য কোন কলেজে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার দূরে থাক, অস্ত্র বহন বা প্রদর্শন ছিলো অকল্পনীয়। মারামারির সময় লাঠি, হকিষ্টিক, বড়জোর ছুরি পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেখা গেছে। শুধু ছাত্র-রাজনীতিতে নয়, দেশের গোটা রাজনৈতিক অঙ্গনে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ছিলো না বললেই চলে। এমনকি পরবর্তী সময়ে শাহী ঈদগাহ এলাকায় শিবির কর্মীদের সাথে জাসদ কর্মীদের হামলার ঘটনায়ও কোন পক্ষকেই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়নি, যদিও ঐ হামলায় নিহতের ঘটনা ঘটেছিলো।
আমাকে একদিন ডানপন্থী একটি ছাত্র সংগঠনের একজন কর্মী এসে জানালো, তাকে নাকি কলেজের জনৈক বামপন্থী নেতা জানিয়েছে, উপর থেকে ডানপন্থীদের কিছু মার দেয়ার নির্দেশ এসেছে। ডানপন্থী ঐ ছাত্রটি যেনো মারামারিতে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য বামপন্থী ঐ নেতাগোছের ছাত্রটি তাকে সতর্ক করে দিয়েছে।
সত্যি সত্যিই কিছিুদিনের মধ্যে একটি মারামারির ঘটনা ঘটে এবং ডানপন্থী দলের জনৈক ছাত্রের পাছায় ছুরিকাঘাত করা হয়। ছুরিকাঘাতের এই ঘটনায় সারা কলেজ জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা চরম আতাংকিত হয়ে পড়ে।
আগে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির অভাব ছিলো না। বিয়ে শাদীর ক্ষেত্রে কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি রাজনৈতিক মতাদর্শ। কিন্তু বর্তমান সময়ে এমনভাবে বিষিয়ে তোলা হয়েছে জাতিকে বিশেষভাবে নতুন ্প্রজন্মকে যে, পাত্র বা পাত্রীর পক্ষের পূর্বপুরুষদের রাজনৈতিক মতাদর্শ বা সম্পৃক্ততা জানতে ইন্টারনেটে পর্যন্ত সার্চ দেয়া হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে ছেলে মেয়েরা পাত্র বা পাত্রীর পিতা বা পরিবারের লোকজন তাদের বিরোধী বা বিশেষ রাজনৈতিক দল করে বা ঐ দলের সমর্থক বলে বিয়ের প্রস্তাব পর্যন্ত ফিরিয়ে দিতে দেখা যাচ্ছে। এটা জাতির জন্য অশনি সংকেত, অশনি সংকেত জাতির বৃহত্তর ঐক্য ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে।
পরিশেষে গণতন্ত্রের মহান প্রবক্তা আব্রাহাম লিংকনের মতো, আমরা বলতে চাই, অর্ধেক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আর অর্ধেক মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা বিরোধী লোক নিয়ে বাংলাদেশের কখনো কাংখিত অগ্রগতি অর্জন সম্ভব নয়। সৌভাগ্যের বিষয়, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে এখন স্বাধীনতা বিরোধী কেউ নেই, আছে বিভিন্ন মত ও আদর্শের মানুষ, আমরা দৃঢ়ভাবে এটা বিশ্বাস করি। একসময় স্বাধীনতা বিরোধী থাকলেও এদের সংখ্যা ছিলো অতি নগণ্য। এদেশে পাকিস্তান কিংবা ভারত বিরোধী লোক থাকতে পারে, তবে স্বাধীনতা বিরোধী কেউ নেই’। আর এটাই আমাদের শক্তির উৎস।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক জালালাবাদ

No comments:

Post a Comment

Pages