মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Saturday, January 5, 2019

শীতে হতদরিদ্র মানুষের অসহায়ত্ব

প্রকৃতির নিয়মে ঋতুর পালাবদল ঘটে। ঋতুবদলের  সাথে সাথে প্রকৃতির রূপও বদলে যায়। শীতের প্রকৃতি শুকনো ও জড়সড়। শীত মানেই হিমহিম কনকনে ঠান্ডার অনুভ‚তি। রাতের আকাশে কুয়াশার অবরণ আর দিনে মিষ্টিরোদের হালকা ছুঁওয়া শীতের প্রকৃতিতে নিয়ে আসে আলাদা আমেজ। প্রতি বছর শীতকাল ঋতুবৈচিত্রের বাংলাদেশে বাড়তি আনন্দ নিয়ে আসে।
------------------------------
মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
------------------------------

কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে কনকনে শীতেও আমরা পাই শাক-সবজি ইত্যাদির অফুরন্ত সম্ভার। এগুলো যেন শীতঋতুর বিশেষ উপহার। লাউ, কুমড়ো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলো, পালংশাক, শালগম, বেগুন, টমেটো, মেটে-আলু, পেঁয়াজের কলি এসব তরকারি রাশি রাশি। গ্রামের হাওর, বিল, ডোবা, ছোটনদী ইত্যাদির পানি কমতে থাকে এবং অনেকটা একেবারে শুকিয়ে যায়। এগুলোতে ধরা পরে কই, সউল, বোয়াল, টেংরা, পুটি ইত্যাদি নানান স্বাদের দেশীয় মাছ। আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতে ভরপুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি প্রিয় বাংলাদেশ।

আমাদের সংস্কৃতিতে শীতকালে নানা ধরনের পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে। শীতের পিঠা খাওয়ার যে আনন্দ, তা সব  আনন্দকেই ছাড়িয়ে যায়। হেমন্তের শেষ দিকে শীতের শুরুতে আমন ধান কাটার পর রকমারি পিঠা তৈরীর ধুম পড়ে ঘরে ঘরে। নানান স্বাদের নানান পিঠা নবান্নের আমেজ চারপাশে উৎসবের সমারোহ তৈরি করে। গ্রামের মতো এখন শহরেও দেখা যায় বিকেলে রাস্তার মোড়ে মোড়ে চিতই আর ভাপা পিঠা তৈরি করছে কেউ কেউ। বিক্রিও হয় প্রচুর। সব মিলিয়ে শীতকাল খুবই উপভোগ্য। এসব যেন শীতঋতুতে মহান প্রভুর দেওয়া নিপুণ উপহার।

শহরের ধনাঢ্য মানুষের মধ্যে হালকা শীত এলেই নানান রঙের নানান ফ্যাশনের গরম পাকড় কিনার ধুম পড়ে; যদিও গ্রামের তুলনায় শহরে শীত কম অনুভূত হয়। ইট-কাঠ-পাথরের দেয়াল আর অহরহ গাড়ির অবিরাম ছুটোছুটি, কল-কারখানা, গ্যাসের চুলা আর অতিরিক্ত ঘনবসতির কারণে শহরের মানুষ বুঝতেই পারে না হাড় কাঁপানো শীত কারে কয়। তবু বস্তি, ফুটপাত আর রেল স্টেশনের খোলা জায়গায় যেসব হতদরিদ্র মানুষ ঘুমায়, তাদের ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য পর্যাপ্ত গরম কাপড় নেই। তারা শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে। তাই তো সকালে সূর্যের তাপ তাদের শরীরের হিম কুয়াশা চুষে না নেওয়া পর্যন্ত তারা জাগতে পারে না। কেউ আবার জেগে ওঠে খড়কুটা, শুকনোপাতা আর ছেঁড়া কাগজ জালিয়ে আগুন পোহায়। 

বিগত কয়েক বছর থেকে আমাদের দেশে শীতকাল একটু স্বল্পমেয়াদি হলেও দুই-তিনটা হালকা ও মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায় দেশের উপর দিয়ে। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের কোনো কোনো এলাকায় তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার রেকর্ডও আছে। এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় শীতটা একটু বেশীই অনুভুত হচ্ছে। বিগত কয়েকদিন থেকে পত্রিকাগুলোর নিউজ থেকে জানা যায়, এবার শীত বেশি হবে। শীতের তীব্রতা অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আবহাওয়াবিদরা।

ইউরোপ আমেরিকা বা অন্যান্য শীতপ্রধান দেশের তুলনায় আমাদের দেশের শীত অনেকটা সহনীয়। শীতকালে এখানে বরফ পড়ে না। ভয়াবহ তুষার-ঝড় প্রকৃতিকে লন্ডভন্ড করে দেয় না। তাপমাত্রাও হিমাঙ্কের ওপরেই থাকে। তবে ইদানিংকালে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে আমাদের দেশের আবহাওয়া অনেকটা অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখা যায়। অনাবৃষ্টি, অকালবৃষ্টি, অকালবন্যা, অকালশীত, তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, তীব্র দাবদাহ ইত্যাদি আবহাওয়ার বৈরী আচরণ আমরা প্রায়ই সহ্য করতে হয়। শীতকালে বিশেষ করে পৌষ ও মাাঘ মাসের কনকনে শীতে আমাদের দেশের অনেক হতদরিদ্র গরিব মানুষ কষ্ট পায়। এমনকি শীতের প্রকোপে কোনো কোনো বছর অনেক  মানুষ মারা যাওয়ার খবরও পাওয়া যায়।

বিত্তবানরা শীতবস্ত্র ব্যবহার করে পরিত্রান পেলেও দরিদ্র লোকেরা শীতবস্ত্রের অভাবে সীমাহীন কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়। কনকনে হিমেল হাওয়া ও তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হতদরিদ্র মানুষের অসহায়ত্বকে প্রকট করে তুলে। সমাজের সচ্ছল মানুষের কাছে শীত আনন্দ ও খুশির বার্তাবহ হলেও দেশের হতদরিদ্র মানুষের জীবনে বেদনার বার্তাবাহক মাত্র। যাদের মাথা গোঁজার ঠাই নেই, তাদের দুরবস্থা যে সর্বাধিক, সে কথা বলাই বাহুল্য। হাঁড়কাপানো শীত ও ঘন কুয়াশা থেকে বাঁচার জন্য দরিদ্র মানুষের প্রয়োজন পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র। শীতজণিত রুগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন সুচিকিৎসা ও ওষুধপথ্য। হাড়কাঁপানো শীতে যে বিপুল জনগোষ্টী বর্ণনাতীত দুঃখ-কষ্টে, অনাহারে-অর্ধাহারে দিন যাপন করছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো ধর্মপ্রাণ মানুষের নৈতিক দায়িত্ব।

আমরা একটু সচেতন হলে হতদরিদ্র মানুষের সাহায্যের মাধ্যমে শীতের আনন্দ-উপহারগুলো ভাগাভাগি করে উপভোগ করার পাশাপাশি ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি লাভ করতে পারব। একটি শীতবস্ত্র একজন হতদরিদ্রকে কিনে দেয়ার সামর্থ অশাকরি পাঠক সমাজের প্রত্যেকেরই আছে। তাছাড়া আমাদের অনেকের ঘরে ব্যবহারযোগ্য অনেক পুরাতন শীতবস্ত্র পড়ে থাকে। অনেকদিন পড়ে থেকে একসময় এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। আমরা চাইলে এগুলো একজন হতদরিদ্র মানুষকে দিয়ে তাকে শীতের কষ্ট থেকে বাঁচাতে পারি। নবী করীম (সঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন মুমিনের পার্থিব একটি মুসিবত দুর করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার মুসিবতগুলো দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোন অভাবী মানুষকে সচ্ছল করে দেবে, আল্লাহ তাকে ইহকাল ও পরকালে সচ্ছল করে দেবেন এবং আল্লাহপাক বান্দাকে সাহায্য করবেন যদি বান্দাহ তার ভাইয়ের সাহায্য করে’। (সহিহ মুসলিম)

অন্য হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়ায় কোন মানুষকে বস্ত্র দান করবে, তাকে কিয়ামতের দিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারণ করা হবে।’ সুতরাং নিজের জাগতিক ও পরলৌকিক কল্যাণের জন্য প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষেরই পার¯পরিক মানবতাবোধ ও উদার মানসিকতা থাকা প্রয়োজন।

সেদিন [৩ ডিসেম্বর, ২০১৮] দৈনিক প্রথম আলোয় দেখলাম ‘অভিযাত্রী’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মহৎ একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা একটি দেয়ালে লিখে রেখেছেন- ‘মানবতার দেয়াল’। দেয়ালে ঝুলছে শীতের বিভিন্ন ধরণের কাপড়। একপাশে ছোট্ট একটি বাক্সে লিখা আছে- ‘আপনার অপ্রয়োজনীয় জিনিস রেখে যান’। অন্যপাশে লেখা আছে- ‘প্রয়োজনীয় জিনিস এখান থেকে নিয়ে যান’। অনেকেই নিজের অপ্রয়োজনীয় তবে ব্যবহার যোগ্য কাপড়গুলো ঝুলিয়ে রেখে যাচ্ছেন। আর অনেকে নিজের প্রয়োজনীয় কাপড়গুলো খুশি হয়ে এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছেন। এমন অভিনব উদ্যোগের নাম দিয়েছেন ‘মানবতার দেয়াল’। সমাজের অবহেলিত অসচ্ছল মানুষের জন্য ‘অভিযাত্রী’ সংগঠনের এই উদ্যোগ প্রসংশনীয়। শীতার্ত মানুষের দুঃখ-কষ্টের অবসান ঘটাতে সরকারী-বেসরকারীভাবে এরকম  উদ্যোগ আরো বেশী গ্রহন করা প্রয়োজন।

আমরা প্রত্যেকেই যদি একটি করে শীতবস্ত্র একজন শীতার্তকে দান করি, তাহলে আশাকরি আমাদের সমাজে ঠান্ডাজণিত কারণে কাউকে কষ্ট করতে হবে না। এই হতদরিদ্র মানুষগুলোকে খুজে পেতে আপনাকে-আমাকে খুব কষ্ট করতে হবে না। আপনার-আমার পাশেই এদের অবস্থান। চেয়ে দেখবেন, হতদরিদ্র মানুষগুলো হাতপেতে আপনাকে-আমাকে ডাকছে আর অপেক্ষা করছে, কখন আপনি একটা শীতবস্ত্র তাকে দান করছেন।

মানবতার সেবায় সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা মানবিক দায়িত্ব। নিঃস্বার্থভাবে শীতার্ত মানুষের সাহায্য ও সেবা করাই মানবতার সেবা। দেশের সর্বস্তরের ধণাঢ্য, বিত্ত¡বান, শিল্পপতি ব্যবসায়ীদের প্রতি উদাত্ত আহব্বান জানাচ্ছি, আপনারা চলতি শীত মৌসুমে শীতার্ত গরীব অসহায় মানুষকে যার যার সামর্থ অনুযায়ী পাড়া মহল্লায় নতুন বা পুরাতন কিছু শীতবস্ত্র বিতরণে এগিয়ে আসুন।

*******************************

মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
(নিবন্ধকার ও কলাম লেখক)
শিক্ষক : জামেয়া ইসলামিয়া আনওয়ারে মদিনা মাদ্রাসা, ইসলামপুর, সিলেট।
hamidsylbd@gmail.com

No comments:

Post a Comment

Pages