মুক্তকন্ঠ - Mukthokonto

স্বাধিন কন্ঠের মুক্ত প্রতিধ্বনি
ব্লগ এডমিন: সেলিম সামীর

Breaking

Thursday, September 14, 2023

হযরত দানাউর রহমান (রহ.)- এর জীবন ও কর্ম

দানাউর রহমান (রহঃ) [ফাইল ফটো]



ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন খুবই আল্লাহভীরু। তাঁর আমল—আখলাক্ব ছিল অতুলনীয়। সবার সাথে  হাসিমুখে কথা বলতেন। বিনয়ী ছিলেন। সৌখিন, পরিপাটি জীবনযাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। আমলের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন খুবই যত্নবান।


** মুহাম্মদ আবদুল হামিদ **

------------------------------------

যুগে যুগে কিছু মানুষ পৃথিবীতে আগমণ করেন যারা দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি আশক্ত হন না। ভোগ—বিলাস আরাম—আয়েশের পরিবর্তে তারা মহান আল্লাহর বন্দেগীতে জীবন উৎসর্গ করাকে পছন্দ করেন। অবশ্যপালনীয় ইবাদাতের পাশাপাশি অধিক পরিমানে ইস্তেগফার, জিকির—আজকার, তাসবীহ—তাহলীল করতে করতে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের তালিকায় তাদের নাম লিখিয়ে নেন। এমনই এক পরহেজগার বান্দা ছিলেন হযরত দানাউর রহমান (রহ.)। তিনি সারাটা জীবন আল্লাহর ওলীদের সংস্পর্শে থেকে নিজের জীবনকে আল্লহর রঙ্গে রঙ্গীন করে তুলেছিলেন।


২৬ নভেম্বর ১৯৩২ ইংরেজি রোজ বুধবার সুনামগঞ্জ জেলার, জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামশি বাজারের পার্স্থ দিঘিরপার গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ওয়াসিল মিয়া। তিনি বিশিষ্ট কোন আলেম ছিলেন না। কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিও নেননি। তিনি স্থানীয় একটি মাদরাসায় ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর কর্মজীবন ছিল কৃষির উপর নির্ভরশীল। স্থানীয় বাজারে ছোটখাটো ব্যবসাও করতেন। পরবর্তীতে ১৯৮৪—৮৫ ইংরেজিতে সিলেটের মেজরটিলাস্থ পশ্চিম ভাটপাড়ায় স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেন।


তাঁর দৈহিক কাঠামো ছিল মাঝারি আকৃতির। তিনি অধিক লম্বাও ছিলেন না আবার খুব বেটেও না। খুব মোটাও না আবার একেবারে চিকনও না। গায়ের রং ছিল ফর্সা। সৌখিন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। লম্বা দাড়ি ও বাবড়ি চুল রাখতেন। পায়জামা, পাঞ্জাবী, লুঙ্গি, টুপি ইত্যাদি ছিলো তাঁর পছন্দের পোষাক।


ছোটবেলা থেকে তিনি আলেম উলামাদেরকে খুবই ভালোবাসতেন। যেখানেই ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন হতো সেখানেই যেতেন এবং রাতভর উলামায়ে কেরামগণের ইসলাহী বয়ান শুনতেন। এরই সুবাদে সিলেটের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামের সাথে যোগসূত্র তৈরী হয়। একপর্যায়ে আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)— এর খলীফা পীরে কামেল আল্লামা লুৎফুর রহমান বরুণী (রাহ.)—এর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন। এরপর থেকে তিনি উনারই দিকনির্দেশনায় জীবন পরিচালনা করতে থাকেন।


মহানবী (সা.)—এর বংশধর মাদানী পরিবারের কেউ সিলেটে এলে তিনি উনাদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। বরুণার পীর সাহেবের সাথে মাদানী পরিবারের সুসম্পর্ক থাকার কারণে ফেদায়ে ইসলাম আল্লামা আসআদ মাদানী (রাহ.)—এর সাথে উনার সুসম্পর্ক তৈরী হয় এবং উনার হাতেও বাইআত গ্রহণ করেন। এছাড়া ওলীয়ে কামেল আল্লামা নূরুদ্দিন গহরপুরী (রহ.), প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান (রহ.), শেখ আবদুল্লাহ হরীপুরী (রহ.), আল্লামা নেজামুদ্দিন (রহ.), সিলেটের বন্দর বাজার জামে মসজিদের ইমাম ও খতীব, দারুস সালাম মাদরাসার শায়খুল হাদিস আল্লামা মুফতি ওলিউর রহমান দা.বা.—সহ শীর্ষস্থানী আলেম—উলামা, পীর—মাশায়েখদের সাথে উনার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সংস্পর্শে থেকে নিজের জীবনকে আলোকিত করে ধন্য হন। এমন এক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হন যে, তিনি সিলেটের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠেন। তাঁর কথা—বার্তা, চাল—চলন, আচার—ব্যবহার দেখে কেউ কেউ তাঁকে ‘পীর সাহেব’ ‘হাজি সাহেব’ বলেও সম্বোধন করতেন।


ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন খুবই আল্লাহভীরু। তাঁর আমল—আখলাক্ব ছিল অতুলনীয়। সবার সাথে  হাসিমুখে কথা বলতেন। বিনয়ী ছিলেন। সৌখিন, পরিপাটি জীবনযাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। আমলের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন খুবই যত্নবান। সুস্থ থাকা অবস্থায় কোনদিন ফরজ নামায কাজা করতেন না। যেখানে থাকতেন সেখানেই নামাজ আদায় করে নিতেন। রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তেন। শেষরাতে তাহাজ্জুদ কখনো মিস করতেন না। তাহাজ্জুদ শেষে জিকির—আজকারে মশগুল হতেন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ‘বিসমিল্লাহি তাওাক্কালতু আলাল্লাহ’— এমনভাবে পড়তেন যে, আশেপাশে কেউ থাকলে শুনতে পারতো।


আর্থিক অসচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর সন্তানদেরকে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেন। তিনি চাইলে সন্তানদেরকে কাজে লাগাতে পারতেন। সন্তানরা অনেক টাকা রোজগার করে তাঁর হাতে দিতে পারতো। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর সন্তানরা আলেম হবে। মানুষের মত মানুষ হবে। তিনি তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে গেছেন। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে তাঁর সাত ছেলে ও এক মেয়ের মধ্য থেকে চারজনই আলেম হয়েছেন। বাকিরাও ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি সাধারারণ শিক্ষায় উচ্চতর ‘ডিগ্রি’ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। এখন তাঁর সন্তানরা কেউ শিক্ষক, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী। আজ অশ্রুসিক্ত নয়নে বাবার জীবনে লিখতে বসছি।


রাজনৈতিকভাবে তিনি কোন দলের সাথে সক্রিয় ছিলেন না। তবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকে খুবই পছন্দ করতেন। ঈমান—আক্বীদা রক্ষার ডাকে যে কোন সভা—সমাবেশে তিনি অংশগ্রহণ করতেন।


সাদাসিদে জীবনযাপনের অধিকারী দ্বীনদার, পরহেজগার, শুকুরগুজার এই ওলীয়ে কামেলকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর সান্নিধ্যে নিয়ে যাওয়াকেই পছন্দ করলেন। অবশেষে ৪ বৈশাখ ১৪২০ বাংলা, ১৭ এপ্রিল ২০১৩ ইংরেজি, বুধবার সন্ধায় তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। রযে যায় উনার সখের জিনিসগুলো। টুপি, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, গেঞ্জি, তাসবিহ, হাতের লাটি, আতর, মেসওয়াক, ঘড়ি, পানের বাটা সবই যেখানে ছিল, সেখানেই পড়ে  থাকে। শুধু তিনি নেই, তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। যখন রাতের আবরণ এসে দিনের আলোকে ঢেকে দিচ্ছিলো। কে জানতো! দিনের সূর্য নিভে যাওয়ার সাথে সাথে নিভে যাচ্ছে দ্বীনের আলোয় আলোকিত এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। পরদিন সকালে ঠিকই পুর্বাকাশে সুনালি সূর্য উদ্বিত হলো। কিন্তু এই নক্ষত্রটি আর কখনো উদ্বিত হলো না। তাঁর ইন্তোকালে ভক্ত—অনুরক্ত, গুণ—গ্রাহীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার মাদরাসার প্রিন্সিপাল আল্লামা হবীবুর রহমান (রহ.) এক শোকবার্তায় বলেছিলেন— ‘এই শূণ্যস্থান কোন দিন পুরণ হওয়ার নয়।’ অবশেষে ১৮ এপ্রিল বাদ জোহর হযরত শাহপরান (রহ.) মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে উনাকে দাফন করা হয়। পরম শ্রদ্ধাভাজন বাবাজান (রাহ.)—কে আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন।


লেখক ঃ মুহাম্মদ আবদুল হামিদ

শিক্ষক ঃ সৈয়দ হাতিম আলী উচ্চ বিদ্যালয়, সাদিপুর, সিলেট।


No comments:

Post a Comment

Pages